জহির রায়হান

জহির রায়হান

জহির রায়হান  একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক, এবং গল্পকার। বাংলা সাহিত্যের গল্প শাখায় অবদানের জন্য তিনি ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৭৭ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক এবং সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৯২ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে। চলচ্চিত্রে তার সামগ্রিক অবদানের জন্য ১৯৭৫ সালে ১ম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাকে মরণোত্তর বিশেষ পুরস্কার প্রদান করা হয়।

তার রচিত প্রথম উপন্যাস শেষ বিকেলের মেয়ে ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়। তার রচিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হল হাজার বছর ধরে ও আরেক ফাল্গুন। হাজার বছর ধরে উপন্যাসের জন্য ১৯৬৪ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র কখনো আসেনি (১৯৬১)। ১৯৬৪ সালে কাঁচের দেয়াল চলচ্চিত্রের জন্য তিনি নিগার পুরস্কার লাভ করেন। তার নির্মিত অন্যান্য চলচ্চিত্রগুলো হল বেহুলা, সংগম, আনোয়ারা এবং জীবন থেকে নেওয়া। স্টপ জেনোসাইড প্রামাণ্যচিত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে প্রশংসিত হন।

জীবনী

প্রারম্ভিক জীবন :

জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার অন্তর্গত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সাথে কলকাতা হতে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) স্থানান্তরিত হন। তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে দু'বার বিয়ে করেন: ১৯৬১ সালে সুমিতা দেবীকে এবং ১৯৬৬ সালে তিনি সুচন্দাকে বিয়ে করেন, দুজনেই ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী।

কর্মজীবন :

জহির রায়হান বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তার সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবন শুরু হয়। ১৯৫০ সালে তিনি যুগের আলো পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি খাপছাড়া, যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবে প্রবাহ পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়। চলচ্চিত্র জগতে তার পদার্পণ ঘটে ১৯৫৭ সালে, জাগো হুয়া সাবেরা ছবিতে সহকারী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে। তিনি সালাউদ্দীনের ছবি যে নদী মরুপথেতেও সহকারী হিসেবে কাজ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম তাকে এ দেশ তোমার আমার এ কাজ করার আমন্ত্রণ জানান; জহির এ ছবির নামসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি রূপালী জগতে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন কখনো আসেনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র সঙ্গম নির্মাণ করেন (উর্দু ভাষার ছবি) এবং পরের বছর তার প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র বাহানা মুক্তি দেন। জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং ২১শে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যার ছাপ দেখতে পাওয়া যায় তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেওয়া"তে। তিনি ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। কলকাতায় তার নির্মিত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেওয়ার বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্রটি দেখে সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ ভূয়সী প্রশংসা করেন। সে সময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করে দেন।

অন্তর্ধান :

জহির রায়হান দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭১ এর ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা ফিরে আসেন এবং তার নিখোঁজ ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে শুরু করেন, যিনি স্বাধীনতার ঠিক আগমুহূর্তে পাকিস্তানী আর্মির এদেশীয় দোসর আল বদর বাহিনী কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলেন। জহির রায়হান ভাইয়ের সন্ধানে মীরপুরে যান এবং সেখান থেকে আর ফিরে আসেন নি। ১৯৭২ এর ৩০ জানুয়ারির পর তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়না। মীরপুর ছিল ঢাকা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত বিহারী অধ্যুষিত এলাকা এবং এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে যে সেদিন বিহারীরা ও ছদ্মবেশী পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশীদের ওপর গুলি চালালে তিনি নিহত হন।

উত্তরাধিকার :

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ জহির রায়হানের দুই স্ত্রী’র একজন সুমিতা দেবী। এই প্রয়াত অভিনেত্রীর দুই ছেলে বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। দুজনেই প্রতিষ্ঠিত নাট্য নির্মাতা। আরেক স্ত্রী সুচন্দা’র ছোট ছেলে তপু রায়হানও অভিনেতা। তিনি ‘সবুজ কোট কালো চশমা’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। জহির রায়হানের ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের মেয়ে শমী কায়সার।

পুরস্কার ও সম্মাননা :

১৯৬৪: হাজার বছর ধরে উপন্যাসের জন্য আদমজী সাহিত্য পুরস্কার

১৯৬৫: কাচের দেয়াল চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র বিভাগে নিগার পুরস্কার

১৯৭২: গল্প সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি প্রদত্ত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার - ১৯৭১ (মরণোত্তর)

১৯৭৭: শিল্পকলায় (চলচ্চিত্র) অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক (মরণোত্তর)

১৯৯২: সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (মরণোত্তর)

২০০৫: হাজার বছর ধরে চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (মরণোত্তর)

উল্লেখযোগ্য কাজ

উপন্যাস :

শেষ বিকেলের মেয়ে (১৯৬০) প্রথম উপন্যাস। প্রকাশকঃ সন্ধানী প্রকাশনী। রোমান্টিক প্রেমের উপাখ্যান।

হাজার বছর ধরে (১৯৬৪) আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবনের পটভূমিতে রচিত আখ্যান। (চলচ্চিত্ররূপ, ২০০৫)

আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯) বায়ান্নর রক্তস্নাত ভাষা-আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত কথামালা।

বরফ গলা নদী (১৯৬৯) প্রথম প্রকাশঃ 'উত্তরণ' সাময়িকী। অর্থনৈতিক কারণে বিপর্যস্ত ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত পরিবারের অসহায়ত্ব গাঁথা।

আর কত দিন (১৯৭০) অবরুদ্ধ ও পদদলিত মানবাত্নার আন্তর্জাতিক রূপ এবং সংগ্রাম ও স্বপ্নের আত্নকথা।

কয়েকটি মৃত্যু

একুশে ফেব্রুয়ারী (১৯৭০)

তৃষ্ণা (১৯৬২)

গল্পসমগ্র :

সূর্যগ্রহণপ্রথম গল্পগ্রন্থ। ১৩৬২ বাংলা।

'সোনার হরিণ

"সময়ের প্রয়োজনে

একটি জিজ্ঞাসা

হারানো বলয়

বাঁধ

নয়াপত্তন

মহামৃত্যু

ভাঙাচোরা

অপরাধ

স্বীকৃতি

অতি পরিচিত

ইচ্ছা অনিচ্ছা

জন্মান্তর

পোস্টার

ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি

কতকগুলো কুকুরের আর্তনাদ

কয়েকটি সংলাপ (১৯৭১)

দেমাক

ম্যাসাকার

একুশের গল্প

অন্যান্য রচনা :

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ (প্রবন্ধ), কলকাতার ঐতিহ্যবাহী 'পরিচয়' সহিত্যপত্রের বাংলাদেশ সংখ্যায় (জুলাই ১৯৭১) এ প্রকাশিত হয়।

অক্টোবর বিপ্লব ও সোভিয়েত চলচ্চিত্র (প্রবন্ধ) , সোভিয়েত বিপ্লবের ৫০ তম বার্ষিকী উপলক্ষে অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক মহাবিপ্লব উদযাপন কমিটির (ঢাকা) স্মরণিকা 'তরঙ্গ'-এ (নভেম্বর ১৯৬৭) প্রকাশিত হয়।

ওদের জানিয়ে দাও (কবিতা)

জহির রায়হান রচনাবলী- ১ম খণ্ড

জহির রায়হান রচনাবলী-২য় খণ্ড

পত্রিকা সম্পাদনা :

এক্সপ্রেস (ইংরেজি সাপ্তাহিক)

প্রবাহ (বাংলা মাসিক

চলচ্চিত্র :

জাগো হুয়া সাবেরা (১৯৫৯)

এদেশ তোমার আমার (১৯৫৯)

নবারুণ (১৯৬০)

যে নদী মরুপথে (১৯৬১)