রবীন্দ্রনাথের অবস্থান মর্মমূলে

রবীন্দ্রনাথের অবস্থান মর্মমূলে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের জাতীয় জীবনের অংশ। সাহিত্য-সংস্কৃতির অবিচ্ছিন্ন তরঙ্গ। বাইশে শ্রাবণের আয়োজনে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে তাঁদের অনুভূতি মেলে ধরেছেন এ সময়ের বাংলা সাহিত্যের দুই প্রবীণ কথাশিল্পী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে লিখতে বসলে তো বিস্তর লেখা যাবে। কত দিকে তাঁর বিস্তার, বাঁক এবং বাঁকান্তর! ভাবছি তাঁর কোন বিষয়টি ধরে লিখব। যদিও অসুস্থতার কারণে আজকাল তেমনভাবে কিছু আর লেখা হয় না, মনে থাকে না কিছু—স্মৃতি শুধু প্রতারণা করে। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর সাহিত্যের স্বাদ ভুলি কেমন করে!

যখন থেকে জ্ঞান-বুদ্ধি হয়েছে, কবিতা-সাহিত্য পড়তে শুরু করেছি, তখন থেকেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মিশে গেছি। সে সময় থেকেই তিনি আমার অংশ হয়ে গেছেন। এটা যে আমার একার ব্যাপার এমন নয়, যেকোনো বাঙালিরই এটা হবে। আমার তো মনে হয়, বাঙালির উপলব্ধির যেসব ক্ষেত্র, তার একটি বড় অংশ জুড়ে আছেন তিনি—রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সাহিত্য ও জীবনাচরণ—দুইয়ের বিবেচনাতেই কথাটি লিখছি। এ জন্য রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে বাঙালির অস্তিত্ব কল্পনা বেশ কষ্টের ব্যাপার।

আমি যখন ছয় বা সাত ক্লাসের ছাত্র, পড়লাম রবীন্দ্রনাথকে। তবে এর আগে থেকেই আমার কৈশোরের দখল নিয়েছিলেন তিনি। আকর্ষণের মূল কারণ ছিল তাঁর গান।

সেই যে রবীন্দ্রনাথে মজে যাওয়া, তাঁর গান, কবিতা ও কথাসাহিত্য ভালোলাগা, সেটি আজও অমলিন। রবীন্দ্রনাথের পর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেককেই পড়েছি। কিন্তু রবিঠাকুরের ব্যাপারটি অন্য। আমি এখন ঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারব না কেন অন্য এক স্থানে আসীন রবীন্দ্রনাথ, কেন তাঁকে এত ভালো লাগে! তবে এটা বলাই যায় যে একসময় আমার অনুভূতির পুরোটা গ্রাস করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

একসময় রবীন্দ্রনাথের সব লেখাই অনেকবার পড়েছি, কিন্তু এখন কেন যে মনে পড়ছে না। বাংলা সাহিত্যকে তিনি চলমান বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত করেছেন। প্রত্যক্ষভাবে না হোক, পরোক্ষভাবে তো বটেই। এই যে কথাটি বললাম, কেন বললাম এটি? মানুষের জীবনের কাছাকাছি পৌঁছাতে, বাস্তবতাকে তুলে ধরতে প্রচলিত ভাষাকে অবলম্বন করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ জীবনকে ধরার জন্য যে মানুষগুলোকে মূর্ত করেছেন, সেগুলো বাস্তবতার কাছাকাছি। বিশেষত গল্প-উপন্যাসে সাধারণ মানুষদের কাহিনি তুলে ধরেছেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন রাজা-মহারাজার আখ্যানই কেবল সাহিত্য নয়, সাধারণ হাটের-মাঠের মানুষও সাহিত্যের অন্যতম বিষয়। বাস্তবতাকে অন্য লেখকেরা তাঁদের লেখাজোখায় যেভাবে তুলে ধরেছেন, রবীন্দ্রনাথের পথ সে রকম নয়। আমাদের চারপাশের দৃশ্যমান বাস্তবতার বাইরে দাঁড়ানো অন্তর্গত আরেক বাস্তবতাও পাওয়া যায় তাঁর সাহিত্যে। ফলে লেখাটি শেষাবধি এক সমগ্রতাকে ধারণ করে।

এখানে এ কথাও বলতে ইচ্ছে করছে, আমাদের সাহিত্যে যে আধুনিকতা, তার নির্মাতা রবীন্দ্রনাথ। এ ক্ষেত্রে যদি তাঁর কথাসাহিত্যকে বিবেচনায় রাখি, দেখা যাবে প্রতিটি আখ্যানেই মানুষের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ, চরিত্র সৃষ্টি, গল্প-উপন্যাসের ভাষার নতুন বিন্যাস, কাহিনির বিন্যাস—সব ক্ষেত্রেই এই আধুনিকতা দৃশ্যমান। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে আমার বন্ধু কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কথা। ইলিয়াস বলতেন, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে আধুনিকতার বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবে এসেছে।

রবীন্দ্রনাথের পরিচয় অনেক—কবি, কথাশিল্পী, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, গীতিকার, সমাজ–সংস্কারক। কিন্তু তাঁর প্রধান পরিচয় কী? কখনো মনে হয় কবি, কখনো মনে হয় গদ্যকার কিংবা গীতিকার হিসেবেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ—সবকিছুর মধ্যে গোটা মানবজীবনকে তুলে ধরেছেন তিনি। তাই নির্দিষ্ট কোনো শাখায় তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণ না করে যদি বলি তাঁর লেখার উপাদানে শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে, তবে বোধ হয় বেশি সমীচীন হবে।

আরও সহজ করে বললে বলতে হবে গল্প, উপন্যাস, নাটক, সংগীত, কবিতা ইত্যাদি রচনার ভেতর দিয়ে আমাদের বাঙালি চেতনাকে গভীরতর ও বিস্তৃত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। একদা নিজে যেমন বলেছিলেন ‘দিেব আর নিেব, মিলাবে মিলিবে’, তাঁর সেই কথা প্রতিফলিত হয় সাহিত্যকর্মেও। তাঁর সাহিত্যের পরতে পরতে ঐতিহ্য যেমন আছে, তেমনি আধুনিকতাও আছে। মানুষের আবেগ, অনুভূতি ও কল্পনা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর লেখায়। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রকে ভোলা যায় না কিছুতেই। আচ্ছা, কেন ভোলা যায় না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর হলো, তাঁর লেখায় আমরা বারবার নিজেকে ফিরে পাই বলেই ভোলা সম্ভব নয় তাঁকে। বাংলা সাহিত্যে তিনি এমন এক পুরুষ এবং তাঁর সাহিত্যকর্ম এমন এক রচনা, যা কখনো মুছে ফেলা যাবে না; যেমন শেক্সপিয়ারকে মুছে ফেলা যায়নি। ফলে রবীন্দ্রনাথ এখনো প্রাসঙ্গিক। কারণ, তিনি আছেন আমাদের মর্মমূলে।