আমি ব্যক্তিগতভাবে পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আবাসিক কলোনি, সাভার, ঢাকায় পেশ ইমাম ও খতিব থাকাকালীন মহিলাদের সাপ্তাহিক ও মাসিক তালিমসহ মাহে রমজানে শুধু তারাবির জামাতের প্রচলন হয়েছিল। অবশ্য তারাবির জামাতে খতমে তারাবি অনুষ্ঠিত হতো মহিলাদের লেডিস ক্লাবে, মসজিদে নয়। কারণ মসজিদে তেমন পৃথক ব্যবস্থা ছিল না। ওই তালিমের দ্বারা আবাসিক কলোনিতে তো ব্যাপক কল্যাণ ও পরিবর্তন সাধিত হয়েছেই, এর পাশাপাশি রমজানের তারাবির খতম ও জামাতের সুবাদে নারী মুসল্লিদের বিরাট উপকার হয়েছে।
দরবেশ সেলিম চিশতিকে সম্মান জানিয়ে ‘সিক্রি’ নামক গ্রামের কাছে ১৫৬৯ সালে সম্রাট আকবর সুন্দর এবং সুরক্ষিত একটি শহর বানিয়ে এর নাম দেন ‘ফতেহপুর সিক্রি’
তাদের নিজের ভাষায়Ñ ‘আমরা এর আগে নামাজই পড়তাম না; এখন তারাবিও পড়ছি এবং অন্যান্য নামাজও পড়ার সৌভাগ্য হচ্ছে।’ কারও কারও মন্তব্য এমনÑ ‘আমরা যারা রোজা পালন করি এবং নিয়মিত নামাজ আদায় করে থাকি; কিন্তু মাহে রমজানে সারাদিন রোজা রেখে সংসারের কাজকর্ম গুছিয়ে ক্লান্তিজনিত কারণে নিয়মিত তারাবি না পড়েই অনেক দিন ঘুমিয়ে পড়তাম। কিন্তু এখন কলোনিতে জামাতের ইন্তেজাম হওয়ায় আমাদের তারাবি তেমন একটা বাদ যায় না।’ কারও কৌতূহল জাগলে এসব বাস্তব অভিজ্ঞতার খোঁজ নেওয়া যেতে পারে।
প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য, হজে গমনকারী মহিলাদের নামাজের বিষয়টিও আমাদের উপরোক্ত শরয়ি আলোচনার মাপকাঠিতেই নির্ধারণ করতে হবে। অর্থাৎ ‘হারাম শরিফ’ এর যে অংশ শুধু মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় তারা যদি সে অংশেই নামাজ পড়েন এবং পুরুষদের সঙ্গে না দাঁড়ান তাহলে তারাও প্রতি রাকাতে লাখো রাকাতের সওয়াব পাবেন। যদি বোরকা-পর্দা ছাড়া গমন করেন এবং পুরুষদের সঙ্গে বা সামনে দাঁড়ান তাহলে শরয়ি আইনের দৃষ্টিতে আমাদের বলতে হবে, তাদের পুণ্যের চেয়ে পাপের সম্ভাবনা বেশি।
এ কারণেই কোনো কোনো আলেম/বুজুর্গ বলে থাকেন, ‘তেমন পরিস্থিতি এড়াতে ঘরে বা ভাড়া বাসায় মহিলাদের নামাজ পড়াই উত্তম।’ অর্থাৎ তাদের কথার মধ্যেও সতর্কতা রক্ষা উদ্দেশ্য, নাজায়েজ বলা বা নিষেধ করা উদ্দেশ্য নয়। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, জাগতিক সব ধরনের আইন-বিধানে যেমন ব্যতিক্রম থাকে তেমনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে শরিয়া আইন-বিধানেও ব্যতিক্রম থাকে। সে হিসেবে হজের মৌসুমের অস্বাভাবিক নারী-পুরুষের উপস্থিতি যেখানে হয়ে থাকে এবং ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সৌদি কর্তৃপক্ষ মহিলাদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ নামাজ-ইবাদতের স্থান সংকুলান করতে পারছেন না কিংবা পারলেও তা পৃথক পৃথকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, অন্যদিকে লাখ লাখ টাকা খরচ করে জীবনে একবার পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যাওয়া মহিলারা ‘ঘরে’ বা ‘ভাড়া বাসায়’ নামাজ পড়ে, জামাত তথা প্রতি রাকাতে লাখো রাকাতের সওয়াব থেকে বঞ্চিত হতে চাচ্ছেন না এবং আজীবনের আবেগ বিসর্জন দিয়ে ঘরে নামাজ পড়ে মানসিক শান্তি পাচ্ছেন না অর্থাৎ মহান আল্লাহর ঘরের মেহমান হয়েও আল্লাহর ঘর থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে (বাসায় নামাজ পড়া অবস্থায়), বাস্তব অবস্থা যেখানে উক্তরূপ এশক-আবেগ-প্রেমের; সেখানে আমরা শরিয়তের স্বাভাবিক অবস্থার সাধারণ আইন বা ফতোয়া জারি করতে যাব না; বরং বিষয়টিকে ব্যতিক্রম মনে করে এড়িয়ে যাব। আমরা পুরুষরা ওই পরিস্থিতিতে যথাসাধ্য নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও বাঁচাতে চেষ্টা করব এবং নারীদের যতটুকু সম্ভব বোঝাব এবং তেমন পরিস্থিতিতে তাদের নামাজ-জামাতও মহান আল্লাহ কবুল করবেন বলে আশা রাখব। নেতিবাচক ফতোয়া দিতে যাওয়া বা কঠোরতা অবলম্বন ঠিক হবে না। কারণ সার্বিক পরিস্থিতি অস্বাভাবিক।
আমার সীমিত জ্ঞান অনুযায়ী মহিলাদের নামাজ জামাতে অংশগ্রহণের বিষয়টি তুলে ধরা হলো। প্রিয়নবীর জীবনাদর্শ, পূর্বাপর হাদিসগুলোতে যা পাওয়া গেছে তা সামনে রেখে এবং হানাফি মাজহাবের প্রামাণ্য গ্রন্থাদির এসংক্রান্ত ইতিবাচক-নেতিবাচক বর্ণনাগুলোর কথা মনে রেখে, হানাফি মাজহাবেরই আইনি মূলনীতিগুলো সামনে রেখে; বর্তমান যুগ-জামানার চাহিদা মোতাবেক তথা সার্বিক মূল্যায়নের নিরিখে ওই ফতোয়া জারি করা হলো। আমার জানা ও বিবেচনা মতে বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, এটিই হানাফি মাজহাবের ফতোয়া।
ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন হানাফি মাজহাব অনুসারী নগণ্য মুফতি। হানাফি মাজহাব সম্পূর্ণ কোরআন-হাদিস-ইজমা-কিয়াসনির্ভর, তাতে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। তবে হানাফি মাজহাবের গভীরে না গিয়ে ফিকহের দু-একটি উদ্ধৃতি আঁকড়ে ধরে রেখে হানাফি মাজহাবকে হাদিসের বিপরীতে দাঁড় করানো কারও পক্ষেই সমীচীন নয়। বিশেষত, যেখানে খোদ ইমাম আজম (রহ.) বলেছেন, ‘আমার বর্ণনা/সিদ্ধান্তের বিপরীতে কোথাও সহি হাদিস প্রমাণিত হয়ে গেলে সেটিকেই তোমরা আমার মাজহাবরূপে ধরে নিও।’ (মুফতি সাঈদ আহম্মদ পালনপুরী : শরিয়া বিষয়ে সিদ্ধান্ত দানের নীতিমালা, পৃ. ৮১)। সুতরাং, তেমন দু-একটি বিষয়ে মাজহাবের খ-িত বর্ণনার বাইরে হাদিস মোতাবেক ফতোয়া দেওয়া হলে, তাতে মাজহাবের কোনো ক্ষতিও হয় না এবং তা মাজহাব বিরোধীও হয় না। উপরন্তু তা-ই মাজহাবের কাম্য।
হজরত আয়েশা (রা.) এর নেতিবাচক মনোভাবসহ আরও যেসব-সাহাবি-তাবেঈ এবং এদের অনুসরণে হানাফি মাজহাবের প্রাচীন ও আধুনিক গ্রন্থাদিতে মহিলাদের মসজিদে গমন বিষয়ে নিষেধের কথা বলা হয়েছে, তা সে ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে যে ক্ষেত্রে পর্দাহীনভাবে এবং পুরুষদের সঙ্গে বা পাশাপাশি মহিলারা নামাজ-জামাতে অংশ নেবে। যে ক্ষেত্রে পর্দা রক্ষা হবে এবং পৃথক ব্যবস্থা থাকবে সে ক্ষেত্রে এ ফতোয়া প্রযোজ্য হবে। সুতরাং এ ফতোয়া ও হাদিসের নেতিবাচক বাচনিক উক্তি এবং ফিকাহ-ফতোয়ার নেতিবাচক উদ্ধৃতির মধ্যে পরস্পর আর বিরোধ থাকল না।
বাংলাদেশে ইসলামি আইন বিধিবদ্ধকরণ বোর্ডে, জাতীয় মসজিদের খতিব মরহুম হজরত মাওলানা ওবায়দুল হক (রহ.) প্রমুখসহ সংশ্লিষ্টরা যে আইন প্রণয়ন করেছেন, সেখানেও মহিলাদের মসজিদে গমন ও জামাতে অংশগ্রহণ করার সুযোগদান তাদের অন্যতম অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। (বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন : তৃতীয় ভাগ, পৃ. ৮৫৮, ৮৬০ ও ৮৮৬)।
জাতীয় মসজিদের মরহুম খতিব আল্লামা উবায়দুল হক (রহ.) কে তার ইন্তেকালের আগে আমার উক্তরূপ ইস্যুকৃত একটি ইতিবাচক ফতোয়া দেখিয়েছিলাম এবং আমার এসংক্রান্ত লিখিত বই ‘মহিলাদের মসজিদে গমন’ এর ফটোকপি তাকে প্রদান করেছিলাম। তা পাঠান্তে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন এবং আমাকে দোয়া ও ধন্যবাদ দিয়েছিলেন।
উপরি-উক্ত আলোচনা ও বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, পর্দা ও পৃথক ব্যবস্থা থাকলে মুসলিম নারীরাও পাঞ্জেগানা, জুমা ও ঈদের জামাতের অনুরূপ তারাবির জামাতেও অংশগ্রহণ করতে পারেন। পরিশেষে, আলোচ্য বিষয়টি বাংলাদেশের রাজধানী শহরসহ সব জেলা, উপজেলা ও থানা শহরের বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে একটি জাতীয় ইস্যু বা সমস্যা হিসেবে বিবেচ্য। তাই ‘ফতোয়া প্রদান নীতিমালার আলোকে বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। লেখক : মুফতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন। উৎস: আলোকিত বাংলাদেশ।