তাল সম্পর্কে কিছু কথা জেনে নিন

তাল সম্পর্কে কিছু কথা জেনে নিন

তালপঞ্চবিংশতি অথবা, পঁচিশ রকমের তাল

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই ছড়াটি তোমরা কে না পড়েছ? মনে পড়ে ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে।’ পাবনার শাহজাদপুরে আসার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রচুর তালগাছ দেখতেন। বিশেষ করে যখন পালকি করে আসতেন। তখন নাকি তিনি এই কবিতাটি লেখেন। আসলেই তালগাছের মতো লম্বা গাছ আর নেই। পাকা ফল ঢিপঢাপ করে গাছের তলায় পড়ে বলেই এর নাম তাল। তালের ইংরেজি নাম Palmyra palm। তালের জন্ম মধ্য আফ্রিকায়। তোমরা কি জান, মানুষের মতো তালগাছেরও মেয়ে গাছ আর ছেলে গাছ আছে। ছেলে গাছের মাথায় লম্বা লাঠির মতো জটা হয়, কোনও ফল হয় না; মেয়ে গাছে ফল হয়- অর্থাৎ তাল ধরে। এখন এস, আমরা শুনি তালের আরও কিছু কথা।

তালের ডোঙা বা নৌকা

এখনো গ্রামের অনেক মানুষ বিলে-ঝিলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য তালের ডোঙা নৌকার মতো ব্যবহার করে। তালগাছের গোড়ার লম্বা একটা খণ্ড দুই ফালি করে চিরে ভেতরের শাঁস তুলে খোলার মতো করে এই ডোঙা বানানো হয়। একটা তালগাছে দুইটির বেশি ডোঙা বানানো যায় না।

তালের রস

ছেলে গাছের লম্বা লাঠির মতো জটা কেটে কেটে তালের রস নামানো হয়। গরমকালে তালের রস হয়। তালের রস খুব মিষ্টি, বিশেষ করে রাতের বেলা খেতে খুব মজা লাগে।

তালগুড়

তালের রস জ্বাল দিলে হয় তালের গুড়। তালগুড় থেকে হয় তালের পাটালি।

তালমিছরি

তালের রস জ্বাল দিয়ে যেমন গুড় হয়, তেমনি বিশেষ পদ্ধতিতে এর গাদ বা ময়লা ফেলে দিয়ে স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো তালমিছরি তৈরি করা হয়। সর্দি-কাশি সারাতে তালমিছরি উপকারী।

কচি তালের শাঁস

কচি অবস্থায় তাল ফলের ভেতরে যে বীজ হয়, তা থাকে খুব নরম। একে বলে তালশাঁস। গরমকালে কচি তালের শাঁস খেতে খুব মজা।

তালগোলা

কচি তালের রং সবুজ; কিন্তু পাকলে রং হয় কালো। ভাদ্র মাসে তাল পাকে। অন্য সময়ও কিছু তাল পাকতে দেখা যায়। সেগুলোকে বলে বারাসে তাল। কালো পাকা তাল থেকে সুঘ্রাণ বের হয়। পাকা তাল টিপ দিলে একটু নরম লাগে। মোটা প্লাস্টিকের মতো কালো খোসা টান দিলে উঠে আসে। ভেতরে পাটের আঁশের মতো কমলা রঙের তালের আঁশ ভর্তি থাকে তালগোলায়। আঁশ চিপলে সেই গোলা বের হয়। তালগোলা কাঁচা ও জ্বাল দিয়ে খাওয়া যায়।

তালপাটালি

ঘন তালগোলার সঙ্গে একটু পান খাওয়ার চুন মিশিয়ে একটা থালায় আধা ইঞ্চি পুরু করে ঢেলে রাখলে কিছুক্ষণের মধ্যেই তা জমে শক্ত হয়ে যায়। ঢালার সময় এর ওপর অল্প কিছু শুকনো চিঁড়া ছিটিয়ে দিলে তা খেতে সুস্বাদু হয় ও চিঁড়া তালগোলার অতিরিক্ত পানি শুষে পাটালিকে শক্ত করে। পাটালি চাকু দিয়ে বরফির মতো কেটে খাওয়া যায়।

তালের ফোঁপা

তাল থেকে গোলা বের করার পর বিচি বা আঁটি গাদা করে রেখে দেওয়া হয়। আশ্বিন-কার্তিক মাসে সেসব আঁটি থেকে গ্যাজ বা অঙ্কুর বের হয়। এরূপ বিচি দুই ফালা করে কাটলে ভেতরে নারিকেলের ফোঁপার মতো তালের ফোঁপা পাওয়া যায়। চিবিয়ে খেতে তালের ফোঁপা বেশ মজা লাগে। বেগুনির মতো তালের ফোঁপা ও চালের গুঁড়ো পানিতে গুলে মাখিয়ে তেলে ভেজে খাওয়া যায়।

তালের তেল

ফোঁপা তোলার পর আঁটির ভেতরে নারিকেলের মতো যে শক্ত শাঁস থাকে, তা তুলে রোদে শুকিয়ে ঘানিতে পিষে তেল বের করা যায়।

তালপাখা

শহরে যারা বড় হয়েছে, তাদের অনেকেই হয়তো তালপাখা দেখেনি। তালগাছের পাতা রোদে শুকিয়ে তারপর বানানো হয় পাখা। তীব্র গরমে তালপাখার শীতল বাতাসে প্রাণ জুড়ায় মানুষ। বাঁশের কাঠির ফ্রেমে তালাপাতা মেলে দিয়ে বানানো হয় তালপাখা। একেকটি তালপাতায় চার থেকে পাঁচটি পাখা হয়।

তালকাঠ

তালগাছের থামের মতো বয়স্ক কাণ্ড করাত দিয়ে চিরে তালকাঠ বানানো হয়। তালকাঠ খুব মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী। টিনের ঘর বানাতে রুয়ো-বাতা হিসেবে তালকাঠ ব্যবহার করা হয়।

তালপিঠা

এক সময় গ্রামে গ্রামে ধুম পড়ত তালপিঠা বানানোর। তালের রস দিয়ে বানানো হতো মজার মজার পিঠা। কী নাম সেসব পিঠার- কানমুচড়ি, তেলপিঠা, পাতাপিঠা, তালমুঠা, তালবড়া, পাতাপোড়া ও তেলভাজা। আরো কত কি! ভাদ্র-আশ্বিন মাসে তাল দিয়ে পিঠা বানিয়ে আত্মীয়বাড়ি পাঠানোর রেওয়াজও ছিল।

তালক্ষীর

তালের গোলা নারিকেল, গুড় ও দুধ দিয়ে জ্বাল দেওয়া হয়। একে বলে তালক্ষীর। তালক্ষীর দিয়ে মুড়ি বা রুটি খেতে খুব মজা লাগে।

তালসুপারি

পাকা তালের আঁটির ভেতর নারিকেলের মতো যে শাঁস হয় তা কেউ কেউ শুকিয়ে কুচি কুচি করে কেটে পানের সঙ্গে সুপারির মতো খায়। একে বলে তালসুপারি। তবে তালসুপারি নামে আরো একটা গাছও কিন্তু আছে এ দেশে। এর ফলও সুপারির মতো, তবে অনেক ছোট।

তালপাতার ঘর

তালপাতা দিয়ে ঘরও বানানো যায়। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের গরিব মানুষ তালপাতা দিয়ে ঘর বানিয়ে থাকে। ঘরের ছাউনি, বেড়া- সবই তালপাতা দিয়ে হয়।

তালপাতার বাঁশি

সেই গানটা কি তোমরা শুনেছ? ‘আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি।’ তালপাতা দিয়ে আসলে খুব সুন্দর বাঁশি বানানো যায়, আর সুর করে মুখে ফুঁ দিয়ে তা বাজানো যায়।

তালপাতার পুঁথি

এখন তোমরা যেমন কাগজে লেখো, প্রাচীনকালে সে রকম কাগজ ছিল না। কাগজ আবিষ্কারের আগে কয়েকটা তালপাতা বেঁধে খাতা বানানো হতো। তাতে কঞ্চির কলম দিয়ে লেখা হতো। এখনো অনেক জাদুঘরে তালপাতার পুঁথি সংরক্ষিত আছে।

তালের টুপি

তালের কাণ্ড পানিতে পচিয়ে এর ভেতর থেকে সেমাইয়ের মতো আঁশ তোলা হয়। সেসব আঁশ দিয়ে সুন্দর করে বুনে তালের টুপি, ঝুড়ি, সাজি ইত্যাদি বানানো হয়। বীরভূম বা বাঁকুড়াতে গেলে তোমরা এসব জিনিস দেখতে পারবে।

তালনবমী

জন্মাষ্টমীর পর দিন নবমী তিথিকে বলা হয় তালনবমী তিথি। এ দিনটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিশেষভাবে উদ্যাপন করেন। বারুইরা তাঁদের পানের বরজে এ দিন পূজা দেন।

তালপুকুর

তালের প্রবাদ ও বাগধারাও আছে। কেউ কেউ ব্যঙ্গ করে অনেক সময় বলে ‘তালপুকুর’। তাল শব্দটি বড় অর্থে ব্যবহৃত হয়। তার মানে তালপুকুর হবে বড় কোনো পুকুর বা দীঘি। কিন্তু বিদ্রূপ করে অনেক সময় বলা হয়, ঘটি ডোবে না আবার তার নাম তালপুকুর।

তিল থেকে তাল

এর অর্থ সামান্য বিষয়কে বড় করে তোলা।

তালপাতার সিপাই

এর অর্থ রুগ্ণ বা ছিপছিপে। কেউ রোগা হলে তাকে বলা হয় তালপাতার সিপাই।

তালগাছের আড়াই হাত

এর অর্থ কষ্টকর বা কঠিন কাজ। তালগাছে যারা ওঠে তারা জানে, এর মাথার আড়াই হাত ওঠা কত কষ্টকর।

তালকানা

এর অর্থ কাণ্ডজ্ঞানহীন। অনেক সময়

আমরা কোনো বোকাসোকা লোককে কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিলে এই প্রবাদ বাক্যটি ব্যবহার করি।

তালগোল পাকানো

এর অর্থ বিশৃঙ্খলা। যখনই কোনো কাজ করতে নেমে তা সুচারুভাবে করা যায় না ও কাজটা যেভাবে হওয়া উচিত ছিল সেভাবে হয় না, তখনই আমরা এই প্রবাদ বাক্যটি ব্যবহার করি।

তালপঞ্চবিংশতি মানে তালের পঁচিশ। এখানে তাল বিষয়ক পঁচিশটি তথ্য আছে। বিশ্বাস না হলে গুণে দেখো।