গোসল করার সময় আপনি কি প্রথমে চুল ধোন, তারপর মুখ ও সবশেষে শরীর ধোন? যদি এমন হয়, তাহলে আপনি বড় ভুল করছেন।
গত ২১ নভেম্বর জাপানের ‘আধুনিক জার্নাল’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ভুল উপায়ে গোসল করার কারণে জাপান প্রতি বছর ১৪ হাজার মানুষ মারা যায়। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে তাপমাত্রা নেমে যাওয়ার কারণে ধমনীতে রক্তের চাপ বেশি হয়। এসময় গোসলকালে পড়ে গিয়ে ডুবে যাওয়ার ঘটনা খুব বেশি ঘটে।
“যদিও গোসল-সংশ্লিষ্ট সরাসরি মৃত্যুর হার কম, তবে ভুল গোসল করার পদ্ধতি সত্যিই পরিচ্ছন্ন হওয়ার কাঙ্খিত ফল আনতে সক্ষম হয় না। উল্টো বিপদ সৃষ্টি করে,” বলছিলেন চীনের ছোং ছিং চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং স্বাস্থ্যরক্ষা কর্মী থাং ছেংলিন।
শীতকালে মানুষভেদে গোসলের পানির তাপমাত্রার তারতম্য হয় বেশ। মানুষের গোসল করার পদ্ধতিও ভিন্ন। অধিকাংশ মানুষ গোসলের সময় প্রথম চুল ধোন। এটা ভুল পদ্ধতি।
থাং ছেংলিন বলেন: “শীতকালে তাপমাত্রা কম থাকে। কাপড় খুলে স্নানাগারে প্রবেশ করার পর রক্ত হৃত্পিণ্ড ও মাথায় ঘনিভূত হয়। স্নানাগারে ঢুকে আগেই চুল ধুলে মাথায় রক্ত সঞ্চালন কমে যেতে পারে। দীর্ঘকাল ধরে এমনভাবে করলে সেরিব্রোভাসকুলার রোগ হতে পারে।” তিনি বলেন, গোসলের সঠিক পর্যায়গুলো হচ্ছে যথাক্রমে মুখ ধোওয়া, শরীর ধোওয়া এবং তারপর চুল ধোওয়া।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রথমে মুখ ধোওয়া হলে শরীর গরম পানির সংস্পর্শে আসার পর লোমকূপ দ্রুত বিস্তৃত হয়। এছাড়া আগে মুখ ধোওয়া হলে মুখের লোমকূপে বেশি ধূলো প্রবেশ এড়ানো যায়।
শরীর ধোওয়া বা পরিষ্কার করার সময় হৃত্পিণ্ড থেকে দূরবর্তী চারটি অঙ্গ আগে ধোওয়া উচিত। এরপর পুরো শরীর এবং সবশেষে চুল ধোওয়া উচিত্। একদিকে ঠাণ্ডা ও গরম পালাক্রমে ব্যবহার করলে মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহে অস্বাভাবিকতা এড়ানো যায়। অন্য দিকে কিছু সময় গরম পানিতে শরীর ধুলে সেই সময়ে মাথার খুলি ও চুল জলীয় বাষ্পে পুরোপুরি আর্দ্র হয়ে ওঠে। এটা পরিষ্কারও সুস্থ চুলের জন্য উপযোগী।
৩টি খুঁটিনাটি হেলা করবেন না।বিষয় অব
১. বর্তমানে বাজারে অনেক ওয়াটার হিটার পাওয়া যায়। যখন বেশ পানির পাইপ কয়েকটি জায়গায় গরম পানি নির্গত করে, তখন ঝরনা অগ্রভাগ থেকে বের হওয়া পানির তাপমাত্রা সম্ভবত দেখানো তাপমাত্রার চেয়ে কম থাকে।
২. গোসল করার সময় স্নানাগারের দরজা শক্ত করে লাগাবেন না, যাতে নিম্ন রক্তচাপের কারণে ঘটা সাময়িক সংজ্ঞাহীনতাসহ অন্যান্য অপ্রত্যাশিত ঘটনায় কেউ সাহায্য করতে পারে।
৩. ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করার অভ্যাস থাকলেও পানির তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে কম না হওয়া ভালো।
মনে রাখুন
গোসল করার আগে গা ঘামিয়ে নিন। গোসলের সময় আকুপাংচার পয়েন্টে মাসাজ করুন। এ দুটি বিষয়ই স্বাস্থ্য রক্ষায় গোসলের গোপন সূত্র।
“নিম্ন তাপমাত্রার পরিবেশ থেকে গিয়ে তড়িঘড়ি গরম পানিতে গোসল করলে মানুষের শারীরিক রক্তপ্রবাহ নিম্ন পর্যায় থেকে উঁচু পর্যায়ে ওঠে হঠাত্ করে। বয়স্ক, শিশু বা হৃদরোগে আক্রান্তদের পক্ষে সেটা সহ্য করা অসুবিধাজনক হয়।
থাং ছেংলিন বলেন, শীতকালে গোসল করার আগে কিছুক্ষণ গা ঘামিয়ে নেওয়া, যেমন পায়চারি করা ও কোমর মোচড়নাসহ বিভিন্ন অনুশীলন করা উচিত্।
সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিস ও গেঁটেবাত রোগীরা ঝরনার অগ্রভাগ দিয়ে আক্রান্ত অংশে গরম পানি দেওয়ার পাশাপাশি মাসাজ করতে পারে, যাতে সেঁক দেওয়ার ফল পাওয়া যায়। এছাড়া পায়ের নিচে ৩ থেকে ৫ মিনিটের মাসাজ করা যায়। থাং ছেংলিন মনে করিয়ে দেন যে, পায়ের নিচে অনেক প্রতিবিম্ব অঞ্চল আছে। গোসল করার সময় যখন রক্তপ্রবাহ দ্রুত হয়, তখন পায়ের নিচে মাসাজ করলে ক্লান্তি দূর হয়। কিন্তু মাসাজ দীর্ঘ সময় ধরে চালানো উচিত না। স্নানাগারে একটি ছোট টুল রেখে সেখানে বসে মাসাজ করা যায়।
গোসলের পানি তাপমাত্রা
শীতকালে গরম পানিতে গোসল করা খুব আরামদায়ক ব্যাপার। ছোংছিং সান্ধ্যপত্রিকা পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী, অনেক মানুষ শীতকালে গোসল করে প্রায় আধা ঘন্টা ধরে। এ সময় পানির তাপমাত্রা থাকে ৪২ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটা খুবই অস্বাস্থ্যকর ব্যাপার।
থাং ছেংলিন জানান, শীতকালে একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির গোসলের সময় ৩০ মিনিটের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। প্রবীণ, শিশু বা হৃদরোগে আক্রান্তদের জন্য এ সময় ২০ মিনিটের বেশি হওয়া উচিত না।
গবেষণা থেকে জানা যায়, ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানিতে ১০ মিনিটের বেশি থাকলে স্নায়ুবিক উত্তেজনা হয় এবং তার ফলে হৃত্স্পন্দনের গতি এবং রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। গোসলের সময় সীমাবদ্ধ রাখা গোসলের শেষভাগে রক্তচাপজতিন সাময়িক সংজ্ঞাহীনতা এড়ানোর মূলমন্ত্র।
খাওয়ার পর গোসল করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না। কারণ খাওয়ার পর মানুষের, বিশেষ করে হৃদরোগে আক্রান্তদের, জিভে রক্ত জমা হয়। খাওয়ার কমপক্ষে এক ঘন্টা পর গোসল করা উচিত্। সিন ছিয়াও হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের ডাক্তার গেং শাও হুয়া বলেন, খাওয়া শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে গোসল করলে বদহজম ও রক্তচলাচলে সমস্যা সৃষ্টি হবে। করোনারি হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের জন্য গোসলের পানির তাপমাত্রা বেশি হওয়া উচিত না। গরমকালে গোসলের পানির তাপমাত্রা দেহের তাপমাত্রার সমান হলে ভালো। আর শীতকাল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি হওয়া উচিত না। যদি শীত লাগে, তাহলে পানি গরম করার সরঞ্জাম ব্যবহার করা যায়। গোসল করার আগে গরম পানি দিয়ে শরীর মুছে নেওয়া যায়। আস্তে আস্তে শরীরের তাপমাত্রা পানির তাপমাত্রার উপযোগী করে নেওয়া যায়।
গোসল কতবার?
শীতকালেও অনেকের দিনে দু’বার গোসল করার অভ্যাস আছে। এটা ত্বকের জন্য ভালো না।
সিন ছিয়াও হাসপাতালের ত্বক বিভাগের ওয়াং রুপেং বলেন, “আবহাওয়া ঠাণ্ডা হলে প্রতিদিন গোসল করার দরকার নেই। সাধারণত সপ্তাহে দু’বার করে গোসল করলেই হয়।” তিনি বলেন, শীতকালে আবহাওয়া শুষ্ক থাকে। এসময় খুব বেশি গোসল করলে ত্বক আরো শুষ্ক হয়ে যায়। এছাড়া মেদ থেকে ক্ষরিত রস পাতলা হলে অ্যাস্টাটোটিক এক্সিমা হতে পারে।
দীর্ঘ সময় পর একবার গোসল করলেও বেশি শক্তি দিয়ে ত্বক ঘষা উচিত না। সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে কোমল স্পঞ্জ দিয়ে হালকাভাবে ত্বক ঘষা।