আজ মুক্তি পেলো বহুল আলোচিত সিনেমা ‘পদ্মাবত’। ছবিটি মুক্তির প্রতিবাদে অগ্নিগর্ভ ভারতের গুজরাট। আহমেদাবাদসহ রাজ্যের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে সহিংসতা। উগ্র হিন্দু সংগঠনের সাম্প্রদায়িক হুমকি উপেক্ষা করেই ভারতসহ বিশ্বের নানা দেশে মুক্তি পেয়েছে ‘পদ্মাবত’। সুপ্রিম কোর্ট ও ফিল্ম সেন্সর বোর্ড ছাড়পত্র দেয়ার পর শত বাধার মধ্যেও সিনেমাটি মুক্তির মুখ দেখল।
এ চলচ্চিত্রটি নিয়ে বিরোধ ও বিতর্কের শুরু ২০১৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর। তবে গত বছরের জানুয়ারিতে এ বিরোধ বড় আকার ধারণ করে।
ওই সময় রাজস্থানের জয়পুরে সঞ্জয় লীলা বানসালির নির্মীয়মাণ ‘পদ্মাবতী’ ছবির শুটিং বন্ধ করে দেয় স্থানীয় রাজপুত জাতির সংগঠন করণিসেনা।
তারা অভিযোগ তুলে ছবিতে রানী পদ্মিনীর সঙ্গে মুসলিম সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজির প্রেমের দৃশ্য রয়েছে, যা ইতিহাস বিকৃতির শামিল। এ অভিযোগ তুলে তারা সিনেমার শুটিং লোকেশনে হামলা করে বসে। এর মধ্য দিয়ে বলিউডের কাছে তারা পরিষ্কার বার্তা পাঠায়-‘বিনোদনের নামে ইতিহাস বদলে দিও না।’
প্রশ্ন হচ্ছে- আসলে বিতর্কের কারণ আর তা কতটুকু যৌক্তিক।
সিনেমায় একটি নাচের দৃশ্য ছাড়াও ছবিতে আছে একটি স্বপ্নের দৃশ্য। যেখানে চিতোর দুর্গ দখলকারী দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির সঙ্গে রানী পদ্মাবতীর একটি ঘনিষ্ঠ ও রোমান্টিক দৃশ্য রয়েছে।
রাজস্থানের রক্ষণশীল রাজপুত সমাজ এতেই ক্ষুব্ধ। কারণ রাজপুত কুলপ্রথায় কোনো রাজা অন্যদের সামনে শরীর দেখিয়ে রানীকে নাচাবেন না। এ ছাড়া তিনি কোনো পুরুষ, বিশেষ করে কোনো মুসলিম পুরুষের সামনে তার রানীকে আনবেন, এ কথা ভাবাই যায় না।
কিন্তু পদ্মাবতীর গল্পটি আসলে কী?
রানী পদ্মিনী কিংবা তার স্বামী রাওয়াররানা রতন সিং অথবা তার কথিত রূপমুগ্ধ সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি আসলেই কতটা জায়গা দখল করেছে চতুর্দশ শতাব্দীর ইতিহাসে?
সিংহলের রাজকন্যা পদ্মাবতী মূলত মালিক মুহম্মদ জায়সী রচিত বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘পদুমাবৎ’-এর চরিত্র। জায়সী তার কাব্য রচনা করেন ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে। এতে তিনি পদ্মাবতীর পাশাপাশি চিতোরের রাজা রত্নসেন, দিল্লির সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি ও রাজা দেবপালের মতো চরিত্র নিয়ে রচিত কাল্পনিক কাহিনীর কাব্যরূপ দেন।
‘পদুমাবৎ’ অনুবাদ করে বাংলায় কাব্যগ্রন্থ ‘পদ্মাবতী’ রচনা করেন মহাকবি আলাওল। এটি বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন।
জায়সীর রচনার প্রায় ১০০ বছর পর আরাকানের বৌদ্ধ রাজার অমাত্য মাগন ঠাকুরের নির্দেশে আলাওল ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে পদ্মাবতী রচনা করেন। তবে ইতিহাসবিদদের ধারণা, কবি চিত্তের কল্পনাই জায়সী এবং আলাওল দুজনকে প্রভাবিত করেছিল।
কথিত আছে, পদ্মিনীর অসামান্য রূপে মুগ্ধ আলাউদ্দিন খিলজি পাগলপারা হলেও যুদ্ধে স্বামীর মৃত্যুর পর রানী পদ্মিনী রাজপুত নারীদের ধর্ম মেনে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেছিলেন।
তবে ইতিহাসবিদরা বলছেন, ত্রয়োদশ শতকের ইতিহাসে পদ্মিনী বা পদ্মাবতী নামে কারও উল্লেখই কেউ কোনোদিন পায়নি।
ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ইতিহাস আলাউদ্দিন খিলজির অস্তিত্ব স্বীকার করে; চিতোরের রাজা রতন সিংয়েরও। দুজনের মধ্যে যুদ্ধে রতন সিংয়ের পরাজয় ঘটেছিল। সেটাও ইতিহাস। কিন্তু রানী পদ্মিনীর কোনো অস্তিত্বই কোনো ইতিহাসে নেই।’
তার কথায়, ‘আলাউদ্দিন খিলজির রাজসভার কবি ছিলেন আমির খসরু। চিতোর আক্রমণের সাক্ষীও তিনি। অথচ তার কোনো লেখাতেও পদ্মিনীর কোনো উল্লেখ নেই!’
ইরফান হাবিব বলেছেন, ‘পদ্মিনীর প্রথম উল্লেখ ১৫৪০ সালে, সুফি কবি মালিক মোহাম্মদ জায়সীর পদুমাবৎ কাব্যগ্রন্থে। সেখানে পদ্মিনী আবার শ্রীলংকার নারী; রাজপুত নন।’
ইতিহাসবিদ ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় এবং গৌতম ভদ্রও ইরফান হাবিবের সঙ্গে একমত। তাদের কথায়, ‘পুরোটাই লোকগাথা, কল্পনাশ্রয়ী একটি সৃষ্টি; ইতিহাস-সংশ্নিষ্ট নয়। বলা চলে, ঐতিহাসিক কল্পকাহিনী।’
অর্থাৎ ঐতিহাসিক একটি কল্পকাহিনী চিত্রায়িত করতে গিয়েই ফেঁসে গেছেন বানসালী। আর খড়গহস্ত হয়েছেন করণিসেনারা।
তবে বিতর্কিত কোনো ফুটেজ বা দৃশ্য সিনেমায় নেই বলে দাবি করেছেন বানসালি। এক ভিডিওবার্তা পোস্ট করে তিনি বলেছেন, ‘ভুল বোঝাবুঝির প্রধান কারণ হলো তথাকথিত স্বপ্নদৃশ্য। অথচ আমি বারবার বলেছি, লিখিত প্রমাণও দিয়েছি যে এমন কোনও দৃশ্য ছবিতেই নেই। বিশ্বাস করুন, ছবিটা আমি খুব দায়িত্ববোধ নিয়ে বানিয়েছি, রাজপুতদের মান-মর্যাদার দিকে দৃষ্টিও দিয়েছি।’
এদিকে সিনেমার যে ‘ঘুমর’ গান নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল সে গানেও রানি রূপে নাচের দৃশ্যে অভিনয় করা দীপিকার উন্মুক্ত পেট স্পেশাল গ্রাফিক্সের মাধ্যমে ঢেকে দিয়েছেন পরিচালক। যে কারণে আসলে এ সিনেমা নিয়ে বিতর্ক উসকে দেশে দাঙ্গা বাধানোর কোনো কারণ নেই উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের।