কিছু কিছু মানুষের জীবনে সুখ যেন অধরাই থেকে যায় আজীবন। এসব মানুষের জীবন শুধুই যাপনের।
নুরজাহান বেগম, বয়স আনুমানিক ৭০ বছর। ধানমন্ডি লেকে ভিক্ষা করেন প্রায় ৭ বছর যাবৎ। থাকেন এই লেকের রাস্তার ধারেই। আপনজনবিহীন এই মানুষটি দিন গুনছেন পরপারে যাবার। আবার নিঃস্ব মানুষটির ২ বছরের সঙ্গী হয়েছে চোখে ছানি। তার জন্ম কুড়িগ্রাম জেলার, উলিপুর উপজেলায় প্রান্তিক এক কৃষক পরিবারে। জন্মের মাত্র ছয় বছরের মাথায় মাকে হারান। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে ঠিকই কিন্তু মায়ের ভালোবাসার পরিবর্তে তার কপালে জোটে অশান্তি।
নুরজাহানের কষ্ট দেখে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান খালা। এভাবে আরো কেটে যায় ৮ বছর। ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় তার। কিন্তু বিয়ের ৬ মাসের মাথায় অমানবিক নির্যাতনের শিকার হন যৌতুকের টাকার জন্য। টাকা না পেয়ে নুরজাহানকে দালালের হাতে বিক্রি করে দেন তার স্বামী মাত্র ৮ হাজার টাকার বিনিময়ে। এরপর শুধুই হাত বদলের গল্প, খদ্দের থেকে খদ্দের, দালাল থেকে দালালে। তার কোলজুড়ে জন্ম নিয়েছিল দুটি সন্তান। ছেলে সন্তানের মুখ পর্যন্ত দেখতে দেননি তারা। মেয়ে সন্তান ২ বছর পর্যন্ত তার সঙ্গেই ছিল। তারপর নিঃসন্তান এক দম্পতির কাছে বিক্রি করে দেন দালালরা।
তিনি জানান, আমার বাচ্চাটি বিক্রি করে দিলেও আমি খুশি। কারণ মেয়েটি বাবা পেয়েছে, মা পেয়েছে। এখানে থাকলে আমার মতো কপাল হতো তার। তবে, সন্তানটিকে ২ বছর বয়সে শেষ দেখেছে সে আর দেখবার সৌভাগ্য হয়নি। তার মেয়ে জীবিত আছে না মৃত তাও জানে না সে। এভাবেই চলতে থাকে তার কষ্টের জীবন। দুঃখের জীবন হলেও পেট পুরে খেতে পারতেন তিনি। কিন্তু বয়স বাড়তে থাকে। খদ্দের কমতে থাকে দিন দিন।
এক সময় যখন খদ্দের শূন্য হয়ে পড়েন, তখন ১৯৯৯ সালে মাত্র দু’হাজার টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে চট্টগ্রামের নিষিদ্ধপল্লী থেকে বের করে দেয়া হয়। এরপর তার জীবন কাটে চট্টগ্রাম রেলবস্তিতে। শুরু করেন চুড়ি, ফিতা বিক্রির ব্যবসা। ভালোই কাটছিলো তার নতুন পথচলা। কিন্তু আবারো বাধা, পূর্বের পেশার কারণে বস্তিতে নানান ধরনের কথার সম্মুখীন হতে হয়। উঠতি বয়সের ছেলেদের চাহিদা পূরণ না করার কারণে চুরির অপবাদ দিয়ে বের করে দেয়া হয় তাকে। এবার চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে শুরু হয় তার ভিক্ষা জীবন।
২০০৮ সালে চলে আসেন রাজধানী ঢাকায়। প্রথম তিন বছর কমলাপুর রেলস্টেশনে কাটলেও এখন তিনি থাকেন ধানমন্ডি লেকে। নিজের বোনের লাশটা পর্যন্ত দাফন করতে পারি নাই। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন প্রায় ৫০ বছর বয়স্ক পলি খাতুন। ভিক্ষা করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে। তিনি জানান, তার বড় বোনের বিয়ের তিন বছর পর দুলাভাই আমাদের পরিবারকে জানান, তার বড় বোন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন, লাশ পাওয়া যাচ্ছে না।
আমাদের পরিবার থেকে কিছুদিন পর আমার সঙ্গে বিয়ে দেন দুলাভাইয়ের। এর বছরখানেক পর আমাকে বিক্রি করে দেন দৌলতদিয়া নিষিদ্ধপল্লীতে। পল্লীতে গিয়ে জানতে পারি আমার মতো আমার বড় বোনকেও বিক্রি করে দেয়া হয়েছে এই পল্লীতেই। এখানেই কাটতে থাকে দুই বোনের সময়। তবে একদিন এক মাতালের আঘাতে মৃত্যু হয় আমার বড় বোনের। কোনো বিচার তো পায়নি বরং আমার বোনের লাশটা পর্যন্ত দাফন করতে পারিনি। নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয় লাশ। মোহাম্মদপুরের একটি হোটেলে সবজি কাটার কাজ করেন প্রায় ৫০ বছর বয়সী এক মহিলা।
তিনি জানান, ভোলায় জন্ম তার। বাড়ির উঠান থেকে তুলে নিয়ে এসে বিক্রি করে দেন ঢাকার একটি হোটেলে। চার থেকে পাঁচ দিন মুখে কাপড় বেঁধে শুধু পানি পান করিয়ে রাখা হয়। এক হোটেল থেকে আরেক হোটেলে চলতে থাকে তার ভয়াল জীবন। প্রায় দশ বছর থাকার পর অনেক কষ্টে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন তিনি। বাড়িতে ফিরে গেলেও পরিবার তাকে নিতে অসম্মতি জানায়। বাধ্য হয়ে আবার চলে আসেন ঢাকায়। শুরু করেন পোশাক শ্রমিকের কাজ। তার বিয়ে হয়েছে, ঘরে সন্তান আছে তিনটি।
তবে সবার কপালে এই সৌভাগ্য হয় না। অধিকাংশ মহিলার মানবেতর জীবন কাটে শেষ বয়সে। সেলিনা খাতুন জানান, আমরা যখন নিষিদ্ধপল্লীতে থাকি তখন আমাদের এক ধরনের ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়। যার কারণে আমাদের শরীর সুস্থ সবল থাকে। কিন্তু যখন আমাদের পল্লী থেকে বের করে দেয়া হয় তখন আমরা এমনিতেই পড়ি বিপদে আবার ট্যাবলেট না খাওয়ার ফলে ভেঙে পড়তে থাকে শরীর। তাই উপায় না থাকার কারণেই ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়াতে হয়। সেলিনা খাতুন ভিক্ষা করেন ধানমন্ডি লেকে।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. ফাহমিদা আক্তার বলেন, তাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের হরমোন সেবন করানো হয় এবং সেই সঙ্গে খাওয়ানো হয় শক্তিবর্ধক ও চেতনানাশক ওষুধ। হঠাৎ এই ওষুধগুলো বন্ধ হয়ে যাবার কারণে শরীরে পানি জমা, শক্তি কমে যাওয়া, অনিয়ন্ত্রিত হ্রদ স্পন্দন, চোখে কম দেখা, ক্ষুধা-মন্দা ইত্যাদি সমস্যার সৃষ্টি হয়। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সহযোগিতা থেকে অধরাই থেকে যায় এসব আজন্ম কষ্টের জীবনের বাসিন্দাদের। এদের সকলেই জানান, খুব একটা সহযোগিতা তারা পান না। মাঝে মধ্যে সামান্য পরিমাণ সাহায্য পেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্যই।