নিশিকন্যা। নিশি জাগছে রাজধানীর রাস্তায়। অলিগলিতে। রাতের আলো-আঁধারিতে শকুনদৃষ্টি তাদের। সাজগোজ আর সুগন্ধির মাদকতায় খুঁজছে সঙ্গী। স্বল্প সময়ের সঙ্গী খুঁজতে কখনো কখনো ফেলছে ফাঁদ। সে ফাঁদে আটকা পড়ে অনেকেই হচ্ছে সর্বস্বান্ত।
‘হাই, হ্যালো, এই যে, চলো, যাবে, তোমার সঙ্গে ঘুরবো, চল রাত কাটাই, হোটেলে যাবে এমন সংক্ষিপ্ত কথায় দেয় পথচারীদের প্রস্তাব। সাড়া পেলেই মন ভোলানো কথার বাহার। দর-দাম। তারপর সিন্ডিকেটের সিএনজিতে উঠে নির্দিষ্ট গন্তব্যে রওয়ানা। অথবা রাস্তার পাশে ঝুপড়ি খাটিয়ে বিছানো শয্যায়।
এভাবে কিছু সময়ের শয্যাসঙ্গী হয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। কিন্তু অসৎ যৌনকর্মী ও ছদ্মবেশী ছিনতাইকারীরা সুযোগ বুঝে জিম্মি করে হাতিয়ে নিচ্ছে সর্বস্ব।
এক্ষেত্রে যৌনকর্মীবেশী হিজড়াদের আচরণ বেপরোয়া। প্রতিরাতে নিশিকন্যারা হাত বদলের সঙ্গে অনেককে প্রতারিতও করে বসছে। গত সোমবার রাতেসহ সম্প্রতি একাধিক রাতে রাজধানীর বহু এলাকায় ঘুরে এমন চিত্র চোখে পড়েছে।
ফার্মগেট মোড়। সোমবার রাত ১১টা ৫ মিনিট। আনন্দ সিনেমা হলের সামনেই চোখে পড়লো ৪ নিশি কন্যার পায়চারী। গাড়ির জন্য অপেক্ষমাণ কয়েক ডজন পথচারীর মাঝে তাদের বিচরণ। তিনজন বোরকা পরা। অপর জন খালি মাথায় চুল খোলা।
মধ্যবয়সী। চোখে চশমা। বিভিন্ন দিক থেকে ফার্মগেট মোড়ের বাস বে-তে পা রাখা পথচারীদের দিকেই তাদের নজর। কারো দৃষ্টি তাদের দিকে স্থির হতেই নজরকাড়া আবেদনময় চাহনি। চোখ টিপ্পনি। অথবা ‘চল’, ‘যাবে’ এমন দু’এক কথায় প্রস্তাব।
এক ব্যক্তি সে আহ্বানে সাড়া দিতেই তার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো চুল খোলা যৌন কর্মী। কাছাকাছি থাকা পথচারীদের সামনেই তাদের কথাবার্তা। ‘চল’। কোথায়? ‘শ্যামলীতে, হোটেলে’। কোন হোটেলে? ‘গিয়ে যেটা খোলা পাই, সেটাতে উঠবা’। কীভাবে যাব। ‘সিএনজিতে’।
কত লাগবে? ‘কতক্ষণ-দু’ঘণ্টা না সারারাত?’ হোটেল ভাড়াসহ …। ‘সিএনজি ডাকবো?’ কোন সমস্যা হবে না তো? ‘সমস্যা হবে কেন? কোন সমস্যাই হবে না। চল’। কিছুক্ষণের কথায় রাজি না হওয়াতে এবার ওই ব্যক্তিকে অন্য প্রস্তাব দেয় সেই নিশিকন্যা।
বলে, ‘তাহলে সিএনজিতে ঘুরবা? খরচও কম।’ এরপর ওই ব্যবসায়ী পাশে দাঁড়ানো সিএনজি চালকের সঙ্গে কথা বললেন। সিএনজি চালক সুমন তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ১ ঘণ্টার সিএনজি ভাড়া ৩০০ টাকা। যেদিকে যেতে চান নিয়ে যাবো। এরপরও রাজি না হওয়াতে ক্ষিপ্ত হয়ে তেড়ে আসে বোরকা পরা তার আরো দু’সহযোগী।
একজন উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘ভদ্রলোক হলে পছন্দ কইরা নিয়া চইলা যাবি। এত কথা বইলা সময় লস করস কেন।’ সেই কথার সঙ্গে অশ্রাব্য গালি তো ছিলই। তবু প্রথম মেয়েটি ওই লোককে ভনিতা করে, ‘১০০ টাকা দাও। চা খাবো’ বলেই পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেয়।
পরে ওই ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। তার নাম রায়হান। একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, এই সিএনজি চালক ও হোটেলের কর্মচারীরাও তাদের সিন্ডিকেটভুক্ত। আমি তাদের পছন্দের সিনজিতে চড়ে তাদের হোটেলে যাবো কেন?
তারা তো ভুলিয়ে-ভালিয়ে সব কেড়ে নেবে। উল্টো জিম্মি করে টাকা আদায় করবে। আবার পুলিশ ধরলে তো আমাদের যা আছে নিয়ে যাবে। তাদের তো কিছু করবে না। এরা সুযোগে বাগিয়ে নিতে পারলেই কেল্লাফতে।
কিছুটা এগিয়ে ফার্মগেট মোড়ের মাঝামাঝিতে চোখে পড়লো আরো ৮ নিশিকন্যার পায়চারী। দর কষাকষি করা আগের নিশিকন্যাকেও পাওয়া গেল। নাম জানতে চাইলে বললো ‘চুমকি’।
সঠিক নাম কিনা জানতে চাইতেই হেসে দিলো। দরকষাকষি করা ওই লোকটি যায়নি কেন জানতে চাইলে বলেন, ‘হে তো ডরায়। খালি ভাবে। এখানে কেন ভাববি। ভাইবাই তো এখানে আসবি।’
তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে এলো আরো কয়েকজন। তাদের কথায় প্রমাণ মিললো খদ্দেরকে প্রতারিত করার কথা। সেলিনা নামে এক ভাসমান যৌনকর্মী বলেন, ‘গতরাতে কামের কথা বলে এক রিকশাওয়ালাকে ওই ফুটওভার ব্রিজের উপর তুলি। আমি প্রথমে ১০০ টাকা নিই। এরপর এক দালাল গিয়ে তার কাছে থাকা বাকি ২০০ টাকা নিয়ে গলা ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিয়েছে।’
নিচে তালা দিয়ে রাখা রিকশাটিও নিয়ে গেছে অন্য কেউ। অপর এক হিজড়া বলেন, গত সপ্তাহে আমি এক বোকা…কে নিয়ে টেক্সিতে ঘুরার কথা বলে বাগে নিয়েছিলাম। কিছুটা গিয়ে প্লাস্টিকের পিস্তল দেখাতেই তার প্রাণ যায় যায়।
সব দিয়ে চলে গেছে। মানিব্যাগে ৬ হাজার টাকা, একটি মোবাইল ও একটি ঘড়ি পাইছি।’এক নিশিকন্যা সাজনার কথা- ‘আমাদের তো এ পথে এনেছে পুরুষরাই। আমার বাড়ি চাঁদপুরে। বাবা-মায়ের ৮ মেয়ে সন্তান। ২ জন মারা গেছে। এখন আছি ৬ জন। আমি সবার বড়।
কয়েক বছর আগে বাবাও মারা গেছে। মা প্যারালাইজড। বসতভিটা ও ছোট্ট এক টুকরো ক্ষেত ছিল। ২০১৪ সালে মা সেই ক্ষেত বিক্রি করে আমাকে বিয়ে দেয়। ৫০ হাজার টাকা বরপক্ষের খাওয়া খরচ ও ৫০ হাজার টাকা যৌতুক দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন হয়। কিন্তু বর বার বার যৌতুক চেয়ে না পেয়ে সমানে নির্যাতন করছিলো।
একদিন বলে সে একটি ব্যবসার জন্য ব্যাংকের ঋণ নেবে। স্ত্রীর স্বাক্ষর লাগবে। এই বলে স্বাক্ষর নিয়ে কিছু দিন পর সেই কাগজ দেখিয়ে বলে আমিই নাকি তাকে তালাক দিয়েছি। তারপর বাধ্য হয়ে মা ও বোনদের মুখের খাবার তুলে দেয়ার জন্য এই পথে নেমেছি।
তার কথা শেষ হতে বোরকা পরা মধ্য বয়সী শানু বলেন, শুধু আমরা পেটের দায়ে রাস্তায় নেমেছি। কেউ কেউ কিছু প্রতারণাও করে। কিন্তু কাস্টমাররাও তো আমাদের ক্ষতি করে।
তিনদিন আগে এই ফার্মগেট থেকে দু’লোক এক নারীকে বাসায় নেয়ার নাম করে গাড়িতে উঠায়। পরে তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় রাস্তায় ফেলে রেখে চলে গেছে। সে এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ততক্ষণে ফার্মগেট মোড়ে নিশিকন্যার আনাগোনা ডজন ছাড়িয়ে যায়। প্রায় একই সংখ্যক সিএনজিচালিত অটোরিকশাও বাস বে-তে অপেক্ষার প্রহর গুনছিল। ফার্মগেট মোড়ের পান বিক্রেতা রিয়াজ উদ্দিন বলেন, শুধু রাতে নয়। দুপুর বা বিকালেও ফার্মগেট মোড়ে যৌনকর্মীদের আনাগোনা থাকে।
কিছুটা এগুতেই রাত ১১টার পর ফার্মগেট মোড়ের উত্তর পাশের খালি পার্কে আলো-আঁধারিতে বেশ কয়েকজন লোকের আনাগোনা চোখে পড়লো। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল তিন নিশিকন্যা ও কয়েক জন লোকের এদিক ওদিক পায়চারী।
নিশিকন্যারা ঝোপের মধ্যে প্লাস্টিকের বস্তার চটের শয্যা পেতেছে। তাদের খদ্দের পটিয়ে সেদিকে নিতে দেখা গেছে। কিছুক্ষণ পর সেখানে গিয়ে এক নিশিকন্যার সঙ্গে কথা হয়।
মধ্যবয়সী ছোটখাট গড়নের ওই নারীর দেহ ভেঙে পড়েছে। এক কথায় তার জীবনের গল্প জানতে চাইলে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। দুঃখ গাঁথার এক পর্যায়ে বলেন, ‘পেটের দায়ে দেহ বিলিয়ে দেয়ার জন্য রাস্তায় নামতে হয়েছে।
এখানে অনেক সময় পুলিশের পিটুনি খেতে হয়। হাড়গোড় পর্যন্ত ভেঙে দেয়।’ এর বেশি কিছু বলতে চাইলে তিনি হাত জোড় করে বলেন, ‘মাপ চাই, চলে যান। আমাকে দু’টা কাজ করতে দেন।
রাত সোয়া ১২টার দিকে যৌনকর্মীদের পদচারণা দেখা গেল ফার্মগেট মোড়ের উত্তর পাশের ফুটওভারব্রিজেও। কয়েকজন ছিন্নমূল নারী-পুরুষকে ঘুমাতেও দেখা গেছে।
রাত সাড়ে ১২টা। বিজয় সরণি মোড়ের পশ্চিম পাশ। একটু এগিয়েই পুলিশের একটি টহল ভ্যান দেখা গেছে। কেউ বাইরে ও কেউ গাড়িতে বসে গল্প-গুজবে মত্ত। তাদের অতিক্রম করে প্রায় একশ’ গজ পর রাস্তার উত্তর পাশে প্রথমে দেখা গেল এক নিশিকন্যাকে।
নাম জানতে চাইতেই বললো বিলকিস। সে পেছনেই একটি দেয়ালের কাছে গাছের সঙ্গে বেঁধে চট টানিয়ে আড়াল করেছে। আরো কিছুটা পশ্চিমে এক সঙ্গে দু’নারী। তাদের ঘিরে কয়েক রিকশাচালক ও পথচারী। দরকষাকষি হয়।
একজন এক খদ্দেরকে নিয়ে ঝুপড়িতে ঢুকে। অপর যৌনকর্মী কিছুটা দূরে গিয়ে বসে। তাদের দু’টো ঝুপড়িই পাশাপাশি। আরো কিছুটা পশ্চিমে এগুতেই রাত ১টার দিকে রাস্তায় বসে আছে দুই হিজড়া।
নাম জিজ্ঞেস করতেই বেপরোয়া ভাবে জবাব এলো স্বরলেখা ও তন্বী। স্বরলেখা বললো, এপাশটায় আমরা ৭ জন হিজড়া কাজ করি। ওপাশে আছে ১৫ মেয়ে। নেত্রীকে জানতে চাইতেই বললো, নেত্রী গ্রামে বাড়িঘর করে চলে গেছে। এখন আমরাই নিজেরা এখানে কাজ করি।
কথা হয় তানিয়া, স্বপ্না ও গতি নামে আরো তিন হিজড়ার সঙ্গে। এক কথা দু’কথায় চোখের জল ছেড়ে অভিশপ্ত জীবনে পা বাড়ানোর নেপথ্য গল্প বলেন তানিয়া। বলেন, আমি তো নিজের দোষে হিজড়া হইনি।
কিন্তু বাবা-মা, ভাইবোন সামাজিক সম্মানের ভয়ে আমাকে কথা শুনাতে শুনাতে এক সময় বাসা থেকে বের করে দেয়। তারপর একে একে ৫টি গার্মেন্টে গেছি চাকরির খোঁজে। কেউ চাকরি দেয়নি। শেষে শেওড়াপাড়ার বাসা থেকে বের হয়ে খোঁজ নিয়ে হিজড়ার দলে এসেছি। এখন এই পথই আমার জীবিকার অবলম্বন।
রাত ২টায় চন্দ্রিমা উদ্যানেও দেখা মেলে নিশিকন্যাদের। ঝোপঝাড়ে দেখা যায় তাদের ঝুপড়ি। রাত আড়াইটার দিকে কাওরান বাজার রেললাইনের পূর্বপাশে এফডিসির বিপরীতেও তিন নিশিকন্যার দেখা মেলে।
একাধিক স্থানে সাক্ষাৎ হওয়া পুলিশ ও যৌনকর্মীরা জানায়, রাত নামলেই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, পল্টন, মহাখালী, বনানী রেললাইন, কমলাপুর রেললাইন, কাকলী, রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, এয়ারপোর্ট রোডসহ শতাধিক পয়েন্টে নিশিকন্যাদের আনাগোনা রয়েছে।
বেশ কিছু দিন ধরে হোটেলে ধরপাকড় চলায় এখন অনেকে নতুন করে রাস্তায় নেমে পড়েছে। খদ্দের নিয়ে উঠছে শ্যামলী, বনানী, মহাখালী, কাওরান বাজার, তেজগাঁও, পল্টনসহ বিভিন্ন এলাকার হোটেলে। বিভিন্ন ফ্ল্যাট বাসায় তো রমরমা যৌন ব্যবসা চলছেই।
নিশিকন্যাদের যৌন বাণিজ্যের আড়ালে সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলে সর্বস্ব হাতিয়ে নেয়ার ঘটনাও কম নয় বলে জানিয়েছেন একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা। তবে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বে থাকা কিছু পুলিশ সদস্যও তাদের আয়ে ভাগ বসায় বলে জানান একাধিক নিশিকন্যা।