নেপাল সরকার সে দেশে গত আট বছরের মধ্যে সংঘটিত নবম ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার কারণ তদন্ত করে দেখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
সরকারের প্রতিশ্রুতির পরও ‘দ্য নেপাল এয়ারক্র্যাফট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন কমিশন’ এবং ‘দ্য সিভিল এভিয়েশন অব নেপাল’-এর ওপর আস্থা রাখা কঠিন। ইইউ অনেক আগেই দেশটির সব বিমান সংস্থাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, কারণ ইইউর নিরাপত্তা কর্মকর্তারা নেপালের বিমান চলাচলবিষয়ক নিয়ন্ত্রকদের নানা কারণে আস্থায় আনতে পারেন না।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘এয়ার সেফটি লিস্ট’ আসলেই একটি সাংঘাতিক তালিকা। এ তালিকায় আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়া অখ্যাত এবং একেবারে স্বল্প পরিচিত বিমান সংস্থার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ইউরোপীয় দেশগুলোর আকাশে উড্ডয়ন নিষিদ্ধ কয়েক শ বিমান সংস্থার মধ্যে নেপালের সরকারি পর্যবেক্ষক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সত্যায়িত করা সব সংস্থার নাম আছে।
ইইউর কালোতালিকায় নেপালের যে ১৭টি বিমান সংস্থার নাম আছে, তার মধ্যে শুধু ‘রয়েল নেপাল’ নামের একটি সংস্থার উড়োজাহাজ একসময় যুক্তরাজ্যে যেতে পারত। কিন্তু বর্তমানে অন্য ১৬ টির সঙ্গে সেটিও নিষিদ্ধ অবস্থায় আছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিমান চলাচলের নিরাপত্তার মান
যখন ক্রমেই বাড়ছে, সে রকম একটি আমলে নেপালে এ ধরনের শিরোনাম হওয়ার ধারা অব্যাহত রয়েছে। প্রায় একই কায়দায় এই ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। সাধারণত খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে ছোট প্রপেলারের উড়োজাহাজগুলো একই ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।
২০১০ সালের আগস্টে অভ্যন্তরীণ বিমান সংস্থা ‘অগ্নি এয়ার’-এর একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে ১৪ জন মারা যায়। উড়োজাহাজটি কাঠমান্ডু থেকে লুকলা যাচ্ছিল। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার কারণে সেটি কাঠমান্ডু ফিরে আসতে যাচ্ছিল। ফেরার সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
২০১২ সালে ঠিক একইভাবে অগ্নি এয়ারের একটি ফ্লাইট একই কায়দায় দুর্ঘটনায় পড়ে। উড়োজাহাজে থাকা ২১ জনের মধ্যে ১৫ জন মারা যায়। ওই উড়োজাহাজটি পোখারা থেকে জমসনের দিকে যাচ্ছিল। খারাপ আবহাওয়ার কারণে সেটি আবার পোখারায় ফিরে আসছিল। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে নেপালের বিমান সংস্থা ‘তারা এয়ার’-এর একটি উড়োজাহাজ কাঠমান্ডুতে দুর্ঘটনায় পড়ে ২২ জনের বেশি লোক মারা যায়।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ‘বুদ্ধ এয়ার’-এর বিচক্র্যাফট ১৯০০ মডেলের একটি উড়োজাহাজ কাঠমান্ডুতে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে ১৯ জন মারা যায়। এর এক বছর পর, ‘সীতা এয়ার’-এর ডরনিয়ার ২২৮ মডেলের একটি উড়োজাহাজ কাঠমান্ডু থেকে লুকলা যাওয়ার সময় বিধ্বস্ত হয়। এতে ৭ ব্রিটিশ নাগরিকসহ মোট ১৯ জন মারা যায়। এ দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে তখন বলা হয়, যাত্রীদের অতিরিক্ত মালামালের ওজনের কারণে উড়োজাহাজটি উড্ডয়নের পর ভারসাম্য রাখতে পারেনি।
২০১৪ সালে ‘নেপাল এয়ারওয়েজ’-এর টুইন ওটোর ব্র্যান্ডের একটি উড়োজাহাজ পোখারা ও জুমলার মাঝামাঝি স্থানে এসে দুর্ঘটনার শিকার হয়। উড়োজাহাজে থাকা ১৮ জনই মারা যায়।
২০১৬ সালে তারা এয়ারের একই মডেলের একটি উড়োজাহাজ পোখারা থেকে জমসম যাওয়ার সময় দুর্ঘটনার মুখে পড়ে এবং ২৩ জনের মৃত্যু হয়। তার দুই দিন পর, ‘এয়ার কাষ্ঠমণ্ডপ’-এর একটি উড়োজাহাজ ১১ জন যাত্রী নিয়ে নেপালগুঞ্জ থেকে জুমলা যাওয়ার সময় দুর্ঘটনার মুখে পড়ে। এতে দুজন ক্রু নিহত হন।
দ্য ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন নেপালে এভাবে দুর্ঘটনার মুখে পড়ে বিমানযাত্রীদের মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে চাচ্ছে। সংস্থাটি বলছে, ‘দেশটির অপার সৌন্দর্যমণ্ডিত ভূখণ্ড অস্বাভাবিক উঁচু-নিচু থাকায় এখানে আকাশযান চলাচলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা পৃথিবীর অন্য সবখানের চেয়ে কঠিন।’
এই ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় দেশটির অভ্যন্তরীণ বিমান সংস্থাগুলোর মধ্যে পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় ধরনের উড়োজাহাজ পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণবিহীন পাইলট দিয়ে চালানোর প্রবণতা আছে। আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে অনেক নিম্নমানের ব্যবস্থাপনায় এগুলো চলাচল করছে। ফলে শিগগিরই এই বিয়োগান্ত গীতির অবসান হবে বলে মনে হয় না।
ফলে এই পাহাড়-পর্বতের রাজ্যে যাঁরা ভ্রমণ করতে চান, তাঁদের বিমানঝুঁকির কথা মাথায় রেখেই যেতে হবে। পাশাপাশি এটাও মাথায় রাখতে হবে, দেশটির সড়কপথও মারাত্মক প্রাণঘাতী। বিবেচনায় রাখতে হবে, যুক্তরাজ্যের চেয়ে সেখানকার দুর্ঘটনার হার ছয় গুণ বেশি।