বিদেশে পাচার ও যৌন কাজের টার্গেট হয়ে উঠছে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়া রোহ্ঙ্গিা মেয়েরা। মূলত ক্যাম্পের অল্পবয়সী মেয়েদের টার্গেট করেছে বিদেশিরা। দারিদ্রতা আর অসহায়ত্বকে পুঁজি করে তাদের এসব কাজে বাধ্য করছে দালালরা। বিবিসি নিউজের দলটি এমন অনুসন্ধান চালিয়ে এর সত্যতা পেয়েছে। পরে তারা বিষয়টি পুলিশকে জানিয়েছেন।
অনুসন্ধান দলটি জানায়, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অল্পবয়সী মেয়েদের টার্গেট করেছে বিদেশিরা। কক্সবাজার থেকে যৌন ব্যবসার জন্য রোহিঙ্গা মেয়ে ও শিশুদের পাচার করা হচ্ছে। তাদের উন্নত জীবনের প্রলোভন আর কাজ দেয়ার কথা বলে বিদেশে পাচার ও যৌন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদেশি খদ্দের সেজে এমন তথ্য পেয়েছে বিবিসি নিউজের একটি দল।
গণমাধ্যমটির একটি দল এবং ফাউন্ডেশন সেন্টিনেল নামের অলাভজনকে একটি প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি কক্সবাজার গিয়েছিল এমন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নেটওয়ার্কগুলো সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে।
অনুসন্ধান শুরুর পর স্থানীয় ছোট হোটেল ও সৈকতের রেজর্ট থেকে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দালালদের টেলিফোন নম্বর, হোটেল ও রিসোর্টে যৌন কর্মকাণ্ডের জন্য রুম ভাড়া পেয়ে যান তারা। পুলিশকে বিষয়টি জানিয়েই দলটি এসব নম্বরে ফোন করে দালালদের কাছে জানতে চায় বিদেশিদের জন্য অল্পবয়সী রোহিঙ্গা মেয়ে পাওয়া যাবে কি না। এর উত্তরে টেলিফোনের ওপার থেকে এক দালাল জানায় ‘অল্পবয়সী মেয়ে আছে কিন্তু রোহিঙ্গা মেয়ে কেন খোঁজা হচ্ছে? ওরা তো খুব নোংরা’। আরও অনুসন্ধানে দেখা গেলো রোহিঙ্গা মেয়েদের সেখানে সবচাইতে সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে। পতিতাবৃত্তির ক্ষেত্রেও তারা সেখানে সবচাইতে নিচের সারিতে রয়েছে।
বিবিসির দলটি দালালকে জানায়, যত দ্রুত সম্ভব তারা এসব মেয়েদের সাথে রাত কাটাতে চায়। খুব দ্রুতই রোহিঙ্গা মেয়েদের পাঠিয়ে দেন দালালরা। যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছর। দালালরা জানায়, ছবির মেয়েদের পছন্দ না হলে আরও বহু আছে। চাইলেই পাওয়া যাবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, যখন খদ্দের থাকে না তখন এসব মেয়েরা অনেক সময় দালালদের বাড়িতে রান্নাবান্না বা ধোয়ামোছার কাজ করে। অল্পবয়সী মেয়েরা ‘ঝামেলা’ করে বলে তাদের দ্রুত বিদায় করে দেয়া হয়। দালালদের সঙ্গে কথাবার্তার রেকর্ডিং ও ভিডিও স্থানীয় পুলিশকেও দেয়া হয়েছে। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে দুটি মেয়েকে উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যায়।
তারা জানান দারিদ্রতার কারণে পতিতাবৃত্তি ছাড়া তাদের জীবন চালানো খুব কঠিন।
পাচার হওয়া নারী ও শিশুদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এ নিয়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় পর্যায়ে নারী ও শিশু পাচারে খুব শক্তিশালী নেটওয়ার্ক দরকার হয়। এ ক্ষেত্রে ইন্টারনেট এখন যোগাযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা মেয়েদের বাংলাদেশের ঢাকা, নেপালের কাঠমান্ডু ও ভারতের কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। কলকাতায় ব্যস্ত যৌন ব্যবসায় এরকম অনেক নারীদের পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করে দেয়া হচ্ছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছে তারা। এরপর তাদের আর খোঁজ মিলছে না।
মিয়ানমারে পরিবারের লোকজনের হত্যাকাণ্ডের পর চৌদ্দ বছর বয়সী আনোয়ারা পালিয়ে বাংলাদেশে আসেন। বিপদগ্রস্ত এই কিশোরীর সেসময় সাহায্য খুবই দরকার ছিল। আর এই অসহায়ত্বের সুযোগটিই নিয়েছে পাচারকারীরা।
তিনি বলেন, ‘একদিন একটি গাড়িতে করে কয়েকজন মহিলা এলো। তারা জানতে চাইলো আমি তাদের সঙ্গে যাবো কি না’।
তাদের প্রতিশ্রুতি ছিল নতুন জীবনের। তাদের সঙ্গে যেতে রাজি হওয়ার পর আনোয়ারাকে গাড়িতে তোলা হল এবং কক্সবাজার নিয়ে যাওয়া হল। ‘খুব বেশিক্ষণ হয়নি তার আগেই ওরা আমার কাছে দুটো ছেলে নিয়ে এলো। তারা আমাকে ছুরি দেখালো। পেটে ঘুষি মারলো। আমি রাজি হচ্ছিলাম না দেখে ওরা আমাকে মারতে থাকলো। এক পর্যায়ে ওরা আমাকে ধর্ষণ করলো।’
বাংলাদেশের কক্সবাজারে ক্যাম্পগুলোতে নারীদের যৌন নির্যাতন ও যৌন পেশায় জড়িয়ে পরার এমন অনেক ঘটনার বর্ণনা পাওয়া গেছে। অল্প বয়সী নারী ও শিশুরা এর মূল টার্গেট। বিপদগ্রস্ত এই নারী ও শিশুদের মূলত কাজের লোভ দেখিয়ে ক্যাম্প থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ক্যাম্পে রোহিঙ্গা শিশু ও তাদের অভিভাবকরা বলছেন দেশের বাইরে কাজ, রাজধানী ঢাকায় বাড়িঘরে গৃহকর্মীর কাজ বা হোটেলে কাজের অনেক প্রস্তাব আসছে তাদের কাছে।