কোনটা রেখে কোনটা বলব। পাতার পর পাতা লিখলেও তাকে নিয়ে লেখা শেষ হবে না । আমার ছোটবেলা-বড়বেলা সব বেলাতেই বাচ্চুর সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল। বন্ধুত্বে কত রকমের সমস্যা হয়। ঝগড়া হয়। কিন্তু বাচ্চুর সঙ্গে কখনোই সে রকম কিছু হয়নি।
আমাদের শুরুর সময়ের কিছু গল্প বলতে চাই। আমরা যখন ‘ফিলিংস’করলাম, তখন আমরা হোটেল আগ্রাবাদের সুইমিংপুলে শো করি। আমি কি-বোর্ড বাজাতাম, বাচ্চু গিটার বাজাত। কিন্তু আমাদের প্র্যাকটিস করার কোনো জায়গা ছিল না। আমি বললাম, ‘কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে আমাদের একটু প্র্যাকটিস করার ব্যবস্থা করা যায় না?’ বাচ্চু গিয়ে কথা বলল। আমরা নাইট ক্লাবে প্র্যাকটিস করার জায়গা পেলাম। কিন্তু শর্ত হলো, এসি ছাড়া যাবে না এবং দুটি লাইটের বেশি জ্বালাতে পারব না। সেখানে আমরা প্র্যাকটিস করতাম সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত। না খেয়ে একটানা এই প্র্যাকটিস করতাম আমরা। প্রচণ্ড ক্ষুধা লাগত। অসুস্থ হয়ে ঘেমেটেমে একাকার অবস্থা হতো। তখন আমরা বের হয়ে আগ্রাবাদ হোটেলের পাশে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের পাশে একটা টিউবওয়েলের কাছে যেতাম। আমরা সেই টিউবওয়েলের পানি হাত আঁজলা করে পান করতাম। বছরখানেক আগে আমি আর ও গিয়ে সেই টিউবওয়েলটা দেখেছি।
আমি ১৯৮২ সালে স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসি। তার কিছুদিন পর বাচ্চুও চলে আসে। একসঙ্গে থাকতাম আমরা। ওর বিয়ে, সংসার—সবকিছুতে আমি যুক্ত ছিলাম। শুরুর দিকে আমি যে বাসায় থাকতাম, সে বাসার পাশেই বাসা ভাড়া নিতে চাইল বাচ্চু। আমার বাসার মালিককে সেই বাসার কথাটা বললাম। তিনি জানালেন, তাঁর কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু ওটা তাঁর বোনের বাসা। সেই বোন রাজি হলেই হলো। সেই বোন মিউজিশিয়ান শুনেই পিছিয়ে গেলেন। কোনোভাবেই গায়ককে ঘর ভাড়া দেবেন না। বাধ্য হয়ে আমি গেলাম এবং বুঝিয়ে বললাম যে সেখানে গানের প্র্যাকটিস হবে না। শুধু থাকবে। পরে তিনি রাজি হলেন। ওই সময় একজন মিউজিশিয়ানের থাকা ও প্র্যাকটিস করা যে কত কষ্ট, সেটা আসলে এখন কেউ বিশ্বাসও করতে চাইবে না।
ওই সময় বাচ্চু একদিন বলে, ‘দোস্ত, আমি একটু একা সবকিছু করতে চাই। নিজেকে একটু তৈরি করতে চাই। তারপরই এলআরবি গড়ে তোলে। বাকিটা তো দেশের মানুষ সবাই জানে। মজার ব্যাপার হলো, বাচ্চু এলআরবির যাবতীয় ক্রিয়েশন, যাবতীয় পরিকল্পনা আমার সঙ্গে শেয়ার করত। শুরুতে একটু ভয় পেত ও, এলআরবি নতুন ধরনের মিউজিক করা শুরু করলে জানতে চাইত, ‘দোস্ত, এসব কি মানুষ নেবে?’ আমি ওকে অভয় দিয়ে বলতাম, ‘তুই চালিয়ে যা। কোনো সমস্যা নেই।’ওদের বিয়ে হয়েছিল মগবাজার কাজি অফিসে। সেটা নিয়েও কম ঝক্কি যায়নি। সব ঝক্কি সামাল দিয়েই ওরা ঘর বেঁধেছিল। এটা দেখে আমার ভালো লাগত।
বাচ্চু ছিল চাপা অভিমানে মোড়ানো একজন মানুষ। ও সবচেয়ে ভয় পেত চিকিৎসক, ওষুধপত্র এবং কাটাছেঁড়ার ব্যাপারগুলো। একবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল কিছুদিন। আমি আর মোহম্মাদ আলী দেখতে গিয়েছি। এক নার্স এসেছে ইনজেকশন দিতে। সিরিঞ্জ দেখেই বলল, এর চেয়ে ছোট সিরিঞ্জ নেই? নার্স মাথা নাড়লেন—নেই। পরে আমরা দুজন বাইরে গিয়ে ছোট সিরিঞ্জ আনলাম। কিন্তু সেটাও বাচ্চুর কাছে বড় হয়ে গেল। আবার গেলাম। এভাবে চতুর্থবার সবচেয়ে ছোট একটা সিরিঞ্জ আনলাম। বাচ্চু বলল, এর চেয়ে ছোট নেই? এবার আমরা জানালাম, এর চেয়ে ছোট সিরিঞ্জ হয় না। বাধ্য হয়ে ওই সিরিঞ্জেই ইনজেকশন দেওয়া হলো। আসলে ও নিজের ব্যাপারে বেশ উদাসীন ছিল। চিকিৎসকের পরামর্শ মানলে বা চললে হয়তো এত দ্রুত ওকে চলে যেতে হতো না।
আমার সঙ্গে বাচ্চুর শেষ দেখা হয়েছিল মানাম আহমেদের ছেলের কুলখানিতে। ওই দিন ও বলেছিল, ‘দোস্ত, পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে আমাদের দেখা হয় না। কথা হয় না। বন্ধুত্ব কিন্তু ঠিকই আছে।’
আমি বলেছিলাম, ‘অবশ্যই। শোন, তুই গেলে আমাকে কাঁধে তুলে নিতে হবে। আমি গেলে তোকে কাঁধে নিতে হবে।’ সবশেষ যেদিন ওর লাশটা কাঁধে নিয়েছি, আমার ওই কথাই বারবার মনে হয়েছে। কিন্তু এত দ্রুত যে ওর লাশটা কাঁধে নিতে হবে, এটা ভাবিনি।