মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটিংয়ের জন্য একটা ক্যাম্প করা হয়েছিল নওগাঁ সীমান্তে ।আবদুল জলিল সেটার দায়িত্বে ছিলেন , যিনি পরে আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। রিক্রুটের পর সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। বুটি ভাই একদিন মুজিবনগরে গিয়ে আমাকে বলেছিলেন, আমি যেন অন্তত একবার ওই ক্যাম্পটা ঘুরে আসি। এতে মুক্তিযোদ্ধারা উজ্জীবিত হবেন। এটা মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকের কথা।
আমি তখন স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের নাটক বিভাগের প্রধান। সিনেমার নায়ক হিসেবে আমার সুপরিচিতি ছিল। একদিন বালুরঘাটের সেই ক্যাম্পে গেলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন নায়ক জাফর ইকবাল। আমাদের তখন খুব অসচ্ছল অবস্থা। ক্যাম্পে কেবল একবেলা খাবারের ব্যবস্থা। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বসে এক দুপুরে ডাল-ভাত আর পাঁপড় ভাজা খেলাম। সেদিন একটা ছেলেকে দেখিয়ে জলিল বললেন, ‘হাসান ভাই, ছেলেটিকে দেখে রাখুন। পরে ওর ঘটনা বলব।’ আমি ছেলেটার দিকে তাকালাম। গ্রামের সাধারণ একটা ছেলে। জলিল কেন তাকে দেখে রাখতে বললেন, ধারণাও করতে পারিনি। রাতে ঘটনাটি শুনে আমি শিউরে উঠেছিলাম।
নওগাঁর গা ঘেঁষে ভারতের সীমান্ত। পাকিস্তানি সেনারা যে পথ দিয়ে সেখানে আসবে, সেখানে একটা ছোট ব্রিজ ছিল। ক্যাম্প থেকে সিদ্ধান্ত হয়, ব্রিজটা উড়িয়ে দেওয়া হবে। এতে পাকিস্তানি সেনারা সহজে গাড়ি নিয়ে ওই পথে আসতে পারবে না। তাদের প্রবেশ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলে আমরা আত্মরক্ষার সময় পাব। ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার আগে রেকি করতে হবে। মানে কখন, কীভাবে যাওয়া হবে, বিস্ফোরক বসানো হবে সেসবের পর্যবেক্ষণ। এ কাজে ছয়জনের একটি দল করে দেওয়া হলো। ব্রিজটি যে গ্রামে, ওই গ্রামের একটি ছেলে আবদার করল, তাকে যেন এই দলে নেওয়া হয়। কিন্তু ক্যাম্পের সবাই বলল, তুই যে মুক্তিযুদ্ধে এসেছিস, সেটা সবাই জানে। তোর সঙ্গে আরও পাঁচটা ছেলেকে দেখলে সবাই সন্দেহ করবে। রাজাকার, আল-বদরেরা টের পেয়ে যাবে।
রেকিতে রাতে যেতে হবে, দিনের আগে ফিরতে হবে। ছেলেটি বলল, ‘রাতে ফিরতে সমস্যা হলে আমাদের বাড়িতে থাকতে পারবেন। মাকে আমার কথা বললেই হবে।’ছয়জনের দলটি রাতের মধ্যে রেকি শেষ করতে পারল না। তারা ওই ছেলের বাড়িতে গেল। ভোররাতের দিকে দরজায় ধাক্কা দিল। ছেলেটির মা-বাবা বেরিয়ে এলেন। পরিচয় দিতেই মা একটা ঘরে তাদের জন্য বিছানা করে দিলেন। দুপুরে তারা খাবে বলে রান্না চড়ালেন। এর মধ্যে ছেলেটির বাবা পাকিস্তানি সেনাদের খবর দিলেন। তারা এসে ছেলেগুলোকে ঘুম থেকে তুলে উঠোনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলল।
এই খবর চলে গেল ক্যাম্পে। সিদ্ধান্ত হলো, ছেলেটির বাবাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। ছেলেটি বলল, যেহেতু আমিই ওদের আমাদের বাড়িতে থাকতে বলেছিলাম, এই অপারেশন আমিই করতে চাই।
রাতের অন্ধকারে ছেলেটি তার বাড়িতে যায়। ছেলেকে দেখে মা তাকে জড়িয়ে ধরেন। বাবা ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসেন। ছেলে চাদরের নিচ থেকে স্টেনগান বের করে বাবাকে গুলি করে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিল।
ছেলেটির সঙ্গে পরে রাজশাহীতে আমার দেখা হয়েছিল। নামটা আজ মনে করতে পারছি না। মুক্তিযুদ্ধের পর রাজাকার, আল-বদরদের মন্ত্রী হতে দেখে, পতাকা লাগানো গাড়িতে চলাফেরা করতে দেখে, ছেলেটি একটু অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যায়। জানি না, সে আজও বেঁচে আছে কি না। রাজাকার বলে নিজের বাবাকেও সে ক্ষমা করেনি।