নির্মাণকাজের অন্যতম উপকরণ রড, সিমেন্ট, পাথর ও বালুর দাম হঠাৎ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। গত বছর জুন থেকে চলতি বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই নয় মাসে রড়ের দাম বেড়েছে টন প্রতি ১৭ হাজার টাকা। বস্তা প্রতি সিমেন্টের দাম বেড়েছে ৪০ টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আবাসন খাত ও সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের বাজেটের আগ থেকে এসব পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। তবে তা হঠাৎ করে অস্বাভাবিকতায় রূপ নিয়েছে। এটা অব্যাহত থাকলে আবাসনসহ সব ধরনের উন্নয়ন মূল প্রকল্পের কাজে ব্যয় কয়েকগুণ বাড়বে। বিশেষ করে আবাসন খাতে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
কনস্ট্রাকশন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মালিকদের সংগঠন বিএসিআই সভাপতি প্রকৌশলী মুনীর উদ্দিন আহমেদ আজ আজকালের খবরকে বলেন, গত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এই তিন মাসেই রড়ের দাম বেড়েছে টন প্রতি আট হাজার টাকা। এখন প্রতি টন রড বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬২ হাজার টাকায়। এর আগে ২০১৭ সালের জুনে রডের দাম এক লাফে আট হাজার টাকা বাড়িয়ে ৪৫ থেকে ৫৩ হাজার টাকা করা হয়। অর্থাৎ, মাত্র নয় মাসে ১৭ হাজার টাকা পর্যন্ত রডের দাম বাড়ানো হয়েছে।
তার দাবি আন্তর্জাতিক বাজারে মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ পর্যন্ত কাঁচামালের দাম বেড়েছে। ফলে রডের দাম এতটা বাড়া যুক্তিসঙ্গত নয়। তার দাবি, নির্বাচন সামনে রেখে উন্নয়ন প্রকল্প যখন সরকার দ্রুত শেষ করতে চায়, তখনই বাড়ানো হয়েছে রডের দাম।
এ প্রসঙ্গে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী ড. তৌফিক এম সেরাজ আজকালের খবরকে বলেন, ২০১৩ থেকে ১৬ সাল পর্যন্ত চার বছর ছিল আবাসন খাতের অন্ধকার যুগ। ২০১৭ সালে সেখান থেকে আলোর মুখ দেখেছে। তবে আলো ফোটার আগেই নির্মাণসামগ্রীর দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে আবারও পেছনে পড়বে আবাসন খাত। তিনি বলেন, হঠাৎ করে রড ও সিমেন্টসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম যেভাবে বেড়েছে তার কোনো যৌক্তিক কারণ তার জানা নেই।
রড উৎপাদনকারী একাধিক প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক দুই সপ্তাহ ব্যবধানে প্রায় সব ধরনের রডের দাম গ্রেডভেদে তিন থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ২০১৭ সালের শেষদিকে রডের বাজারদর (৬০ গ্রেড) ৫১ থেকে ৫২ হাজার টাকার মধ্যে ওঠানামা করলেও বর্তমানে সর্বোচ্চ ৬২ হাজার টাকায় উঠে গেছে। এ দিকে হঠাৎ দাম বেড়ে যাওয়ার খবরে বাজারে কিছুটা সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে বলে খুচরা বিক্রেতারা জানান।
রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী তানভিরুল হক প্রবাল বলেন, হঠাৎ করে রডের দাম বাড়া অযৌক্তিক এবং অনৈতিক। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে অনেক প্রতিষ্ঠান রড তৈরি করছে। চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই। নতুন করে কোনো শুল্ককরও বাড়ানো হয়নি। ফলে রডের মূল্যবৃদ্ধির কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
তবে এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে রড প্রস্তুতকারক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ রি-রোলিং মিলস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মাহবুবুর রশীদ জুয়েল বলেন, হঠাৎ করে রডের দাম বাড়েনি। ধীরে ধীরে একটু একটু করে বেড়েছে। কারণ সম্প্রতি কাঁচামালের দাম বাড়ছে। তাই বিশ্ববাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই দাম বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে, লোকসান এড়ানোর কথা বলে গত বছরের শেষ দিকে সিমেন্টের দর ১০ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন উদ্যোক্তারা। তবে এখন ৫০ কেজির প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম তিন দফায় ৬০ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে গত কয়েক মাসে সিমেন্টের মূল কাঁচামাল ক্লিংকারের দাম বেড়েছে। কয়েক মাসের ব্যবধানে ক্লিংকারের টনপ্রতি দর ৩৫-৩৮ ডলার থেকে বেড়ে ৫০-৫২ ডলারে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় লোকসান পুষিয়ে নিতে খুচরা পর্যায়ে সিমেন্টের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গত মার্চের শুরুতেই প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম ২০ টাকা বাড়ানো হয়। গত বৃহস্পতিবার থেকে প্রতি বস্তার দাম আরও ২০ টাকা বেড়েছে। এমনকি আগামী ১৫ মার্চ থেকে বস্তাপ্রতি আরও ২০ টাকা দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হতে পারে, সিমেন্ট প্রস্তুতকারক ও বাজারজাতকরণ সমিতির পক্ষ থেকে এমনটাই জানানো হয়েছে।
সমিতির নির্বাহী পরিচালক বেলাল হোসাইন বলেন, সিমেন্টের দাম বাড়ানো নয়, বরং সমন্বয় করা হচ্ছে। চীনসহ বেশ কয়েকটি ক্লিংকার রফতানিকারক দেশে দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে সিমেন্ট উৎপাদনের খরচ বেড়েছে। ২০১৭ সালে দেশের প্রায় সব উৎপাদক প্রতিষ্ঠান লোকসান গুনেছে। বাধ্য হয়েই চলতি বছর সিমেন্টের দাম উৎপাদন খরচের সঙ্গে সমন্বয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
নির্মাণকাজের আরেক অপরিহার্য উপকরণ পাথরের দামেও ঊর্ধ্বগতি। বর্তমানে সিলেটি এক নম্বর পাথর বিক্রি হচ্ছে প্রতি বর্গফুট ১৯০ থেকে ২০০ টাকায়। যা কিছুদিন আগেও ছিল ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা। ইন্ডিয়ান ও চায়না পাথরের দাম ১৮৫ থেকে ১৮৮ টাকা করে।
শেলটেকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী কুতুবউদ্দিন আহমেদ আজকালের খবরকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আবাসন ব্যবসায় মন্দা ছিল। সেখান থেকে ২০১৭ সাল ছিল রাইজিং পিরিয়ড। বছরটিতে মোটামুটি ভালো ব্যবসা হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেও ব্যবসার পরিস্থিতি ভালো। কিন্তু ব্যাংক সুদের হার আবার বাড়ছে। রড-সিমেন্টের দাম হঠাৎ করে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এ খাতের জন্য এটি ভালো লক্ষণ নয়।