নীলফামারী জেলার কৃতী সন্তান কর্নেল নাজমা বেগম প্রথম নারী হিসেবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে একটি কন্টিনজেন্ট কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছে।
‘সন্ধ্যা থেকেই হালকা দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। খবর এসেছে, সে রাতে আত্মঘাতী হামলা হবে। এমন সময় মরক্কো সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিসান ডেকে পাঠালেন আমাকে। তিনিও সাবধান থাকতে বললেন। আমি এবার সত্যি নার্ভাস হয়ে গেলাম। কিন্তু ৫৬ জনের একটি দলের নেতৃত্বে আছি, নিজের দুশ্চিন্তা প্রকাশ করা যাবে না।
দলকে ডেকে পাঠালাম, বললাম, আমরা কাউকে ভয় পাই না। যা আছে, তা-ই দিয়ে মোকাবিলা করব। আমাদের সবার আগে দেশ। সবাই বলে উঠলেন, জি স্যার। সবাইকে অভয় দিয়ে আমার রুমে ফিরে গেলাম। জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ইউনিট কমান্ডারের হাতে একটি মোবাইল ফোন দেওয়া হয়। জরুরি বাটন টিপলেই সব জায়গায় বিপদের বার্তা পৌঁছে যাবে। রাত বাড়তে লাগল। হঠাৎ শুরু হলো ঝড়-বাতাস।
ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। শেষ ভরসা জরুরি মোবাইলও বন্ধ হয়ে গেল। দূর থেকে গাড়ির শব্দ আসতে থাকল। আমি সতর্ক হয়ে গেলাম। আমার ডেপুটি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল সোলায়মান বললেন, ‘স্যার, যা-ই হোক, দেশের জন্য এসেছি। শেষ পর্যন্ত আমরা লড়ে যাব।’ অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভোর হলো। দিনের আলো ফুটল। শেষ হলো উৎকণ্ঠার রাত। সকাল আটটা থেকে আবার রোগী দেখতে শুরু করলাম আমরা।’
এই গল্প কর্নেল নাজমা বেগমের। তাঁর ঢাকা সেনানিবাসের বাসায় বসে কথা হচ্ছিল ৫ ফেব্রুয়ারি।
ওপরের ঘটনা ২০১৬ সালের। সে বছরই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন বিশেষ স্বীকৃতি এনে দিয়েছে তাঁকে। হয়েছেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের প্রথম মেডিকেল কনটিনজেন্ট নারী কমান্ডার। এর আগে ২০০৭ সালেও তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে গিয়েছিলেন। ‘আমিই যে প্রথম, সেটা জানতাম না। বাংলাদেশ থেকে প্রথম সেটা বুঝেছিলাম। কিন্তু আইভরি কোস্টে গিয়ে জানলাম। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু নয়, বাংলাদেশের নারীদের জন্য মনে হয়েছিল কিছু করতে পেরেছি।’ বললেন নাজমা।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের দিনগুলো খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল তাঁর কাছে। যেহেতু তাঁরা চিকিৎসক ছিলেন, ফলে তাঁদের সঙ্গে আত্মরক্ষার তেমন কোনো কিছু থাকত না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতেন নাজমা ও তাঁর দল।
সব সময়ই ভিন্ন কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন নাজমা। ছোটবেলায় মনে করতেন চিকিৎসক হবেন। নীলফামারীর মেয়েটি রংপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন। চিকিৎসকও হলেন। তবে সনো ও ইকো কার্ডিওলজিস্ট হন তিনি। এর পেছনের কারণ জানা গেল কথার মধ্যে। তাঁর বড় মেয়ে কিছুদিন আগে মা হয়েছেন। মেয়ে আলট্রাসাউন্ড করেছেন নারী চিকিৎসকের কাছে। মেয়ে নিজেও চিকিৎসক। কিন্তু নারীর কাছে করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন। এমন অনেক নারীর কথা ভেবেই বহু বছর আগে নাজমা বেগম এই পেশা বেছে নেন।
নিজের কাজ খুব নিষ্ঠার সঙ্গে করতে চান তিনি। মনে করেন, নতুন কিছু কোনো নারী যদি ভালো করেন, তাহলে আরও অনেক নারীর জন্য সেই পথ খুলে যায়। জীবনের চড়াই-উতরাইকে পাত্তা দিতে চান না। ‘এমন একটা সময় ছিল, যখন আমার যেকোনো বিষয়ের দুশ্চিন্তা চেহারায় প্রকাশ পেয়ে যেত। এতে অনেকে আমার ওপর আস্থা রাখতে পারত না। নিজে নিজে মুখে হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করতাম সব পরিস্থিতিতে। চর্চার পর্যায়ে নিয়ে গেলাম। আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম, কখন যে আমার মনের ভেতরটা পরিবর্তন হয়েছে, বুঝতেও পারিনি। মুখের হাসি আমার হৃদয়ে হাসি এনে দেয়। নারীদের জন্য আমার একটা পরামর্শ, সব সময় ইতিবাচক ভাবনা ভাবতে হবে। এতে ভালো কিছু হবেই।’ বললেন নাজমা।
কোনো নারীকে একটা পর্যায় পর্যন্ত এগিয়ে আসতে হয়। কাজটাও নিজেকে একাই শুরু করতে হবে। সফলতার একটা ধাপ ছুঁয়ে ফেলতে পারলে অন্য অনেকের সহযোগিতা পাওয়া যায়। এমনটা মনে করেন এই সেনা কর্মকর্তা।
কী করতে ভালোবাসেন? নাজমা বললেন, ‘লেখালেখি করতে। যখনই সময় পাই, হয় বই লিখি, গান লিখি, কখনো গিটার বাজাই। গান গাই। আর নিজে সাজতে পছন্দ করি। এ জন্য হতাশ হওয়ারও সময় পাই না।’ বলেই হেসে ফেললেন। এই হাসি সফলতার, দৃঢ়তার।
উল্লেখিত, নাজমা বেগমের বাড়ি নীলফামারী শহরে। তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন নীলফামারী সরকারি বালিকা বিদ্যালয় ও নীলফামারী কলেজ থেকে। এরপর পড়াশোনা করেন রংপুর মেডিকেল কলেজে। ১৯৯৩ সালে নাজমা বেগম সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে যোগ দেন।