স্টিভেন হকিংকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভিন্ন মিডিয়ার লেখালেখি দেখে আমার কাছে মনে হয়েছে লেখাগুলো অতিরঞ্জন দোষে দুষ্ট ও হীনম্মন্যতাপূর্ণ। কারণ এর চেয়ে বড়ো বিজ্ঞানী আমাদের ছিল কিন্তু তাকে নিয়ে আমরা এমন করিনি। তাই হকিংকে নিয়ে লেখা আমার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়। এই বাড়াবাড়ি দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না, আসলে বাঙালির কোনো আত্মমর্যাদা নেই। নেই স্বকীয় ঐতিহ্য তুলে ধরার সামর্থ্য। তারা কেবল নিজেদের অবহেলা করে পরকে মাথায় নিয়ে নাচে। সে কারণে অনেক মেধাবী থাকা সত্তে¡ও আমাদের অবস্থান পাতালের অতলে।
বলছিলাম, হকিংয়ের চেয়ে অনেক মেধাবী এবং বড়ো বিজ্ঞানী বাংলাদেশে ছিল। তিনি জামাল নজরুল ইসলাম। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ ফেব্রয়ারি ঝিনাইদহ শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বলা হয়, আধুনিক বিশ্বের সাত জন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর নাম নিলেও জামাল নজরুল ইসলামের নাম চলে আসবে। তিনি সারা বিশ্বে জেএন ইসলাম নামে পরিচিত এবং বিজ্ঞানীদের কাছে বাংলাদেশ জেএন ইসলামের দেশ হিসেবে পরিচিত। জেএন ইসলাম ছিলেন ক্যাম্ব্রিজে হকিংয়ের রুমমেট, বন্ধু এবং সহকর্মী। প্রায় অর্ধ ডজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ বন্ধু জেএন ইসলামকে বলা হতো আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম মেধাবী মানুষ। কেন এমন বলা হতো, তার দুটি উদাহরণ দিই। ক্যাম্ব্রিজের ট্রিনিটি থেকে গণিতে ট্রাইপস পাস করতে লাগে তিন বছর। জেএন ইসলাম তা দুই বছরে শেষ করে বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিলেন। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর তাবৎ বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সে সময় জামাল নজরুল ইসলাম গণিতের হিসাব কষে পৃথিবীর মানুষকে আস্বস্ত করে বলেছিলেন, সে রকম কোনো আশঙ্কা নেই। কারণ, প্রাকৃতিক নিয়মে সৌরজগতের সবগুলো গ্রহ একই সরলরেখা বরাবর চলে এলেও তার প্রভাবে পৃথিবী নামক গ্রহের কোনো ক্ষতি হবে না।
চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় এত ভালো করেছিলেন যে, শিক্ষকৃবন্দ তাকে ডাবল প্রমোশন দিয়ে এক শ্রেণি উপরে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের শিক্ষক ফাদার সোরে জেএন ইসলামকে ডাকতেন জীবন্ত কম্পিউটার বলে। অন্যান্য বিজ্ঞানী যেখানে কম্পিউটার ও ক্যালকুলেটর নিয়ে কাজ করতেন সেখানে জেএন ইসলাম এগুলি ছাড়াই বড়ো বড়ো হিসাব মুহূর্তে করে দিতেন। তিনি বলতেন, কম্পিউটার আমার কাছে অপ্রয়োজনীয়। তবে তিনি কম্পিউটারের সাধারণ প্রয়োজনীয়তা কখনো অস্বীকার করেননি।
একাধারে পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত¡বিদ ও অর্থনীতিবিদ জেএন ইসলাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে হকিং বলেছিলেন, ‘জেএন ইসলাম আমার রুমমেট, বন্ধু এবং আমরা ছিলাম পরস্পর পরস্পরের শিক্ষক।’ ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হকিং যেসব বিজ্ঞানীদের নিয়ে গবেষণা করেছেন, তন্মধ্যে জেএন ইসলাম ছিলেন অন্যতম। যেমন বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু প্রথম রেডিও আবিষ্কার করলেও কৃতিত্ব চলে গিয়ছিল মার্কনির কাছে। ঠিক তেমনটি ঘটেছে জেএন ইসলামের ক্ষেত্রেও। স্টিফেন হকিং যদি বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী হন, তাহলে জেএন ইসলাম ব্রহ্মান্ড খ্যাত। বাংলাদেশের কোনো পত্রিকায় তাকে নিয়ে এভাবে লেখা হয়নি, যেমনটি লেখা হয়েছে হকিংকে নিয়ে। নিজের ভাই মহাশয়, এই জ্বালা কি প্রাণে সয়? বাঙালিরা এই বোধ থেকে কখন বের হয়ে আসতে পারবে জানি না।
পদার্থবিদ্যার আবিষ্কার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণ করতে হয় কিন্তু হকিংয়ের কোনো বর্ণনা তিনি প্রমাণ করতে পারেননি। এজন্য তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি। তাই অনেকে মনে করেন, হকিং যত বড়ো না বিজ্ঞানী তার চেয়ে বেশি বিজ্ঞানকল্পকাহিনির লেখক। তিনি মেধাবী ছিলেন নিঃসন্দেহে, তবে বিশ্বব্যাপী যে প্রচার তিনি পেয়েছেন তা শুধু মেধার জন্য নয়, বরং তার অসুস্থতা, অমুসলিম এবং ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ার জন্য ঘটেছে। কিন্তু জামাল নজরুল ইসলাম নিজ দেশ থেকেও এমন মূল্যায়ন পাননি। প্রচার ছাড়া প্রসার কীভাবে হয়? বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত জামাল নজরুল ইসলামের লেখা ‘কৃষ্ণবিবর’ গ্রন্থটি হকিংয়ের ব্ল্যাকহোল থিউরির অনেক আগেই প্রাচ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত। কিন্তু আমরা কেউ তা জানি না। জানলেও তা কেউ প্রচার করিনি।
সারা বিশ্বে বিজ্ঞানী মহলে জেএন ইসলাম জিনিয়াস ইসলাম নামেও পরিচিত ছিলেন। জাপানি প্রফেসর মাসাহিতো বলেছেন, ‘ভারতের বিখ্যাত জ্যোতিপদার্থ বিজ্ঞানী জয়ন্ত নারলিকা জেএন ইসলামের সহপাঠী ছিলেন। ফ্রেডরিক হয়েল, নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ব্রায়ান জোসেফসন, স্টিফেন হকিং, প্রফেসর আব্দুস সালাম, রিচার্ড ফাইনমেন, অমর্ত্য সেন প্রমুখ ছিলেন জামাল নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাদের মুখে আমি অনেক বার জেএন ইসলামের কথা শুনেছি। জেএন ইসলামের ‘দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স’ লেখা হয়েছে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে কিন্তু হকিংয়ের ‘অ্যা ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম’ লেখা হয়েছে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে। দুটি গ্রন্থ তুলনা করলে নিঃসন্দেহে জেএন ইসলামের বইটি যে কোনো বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ। কিন্তু ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম নিয়ে আমরা যে তোলপাড় করেছি, জেএন ইসলামের আল্টিমেট ফেইট নিয়ে তার এক সহশ্রাংসও করিনি।
হকিং তাঁর মূল্যবান গবেষণা সময়ের অধিকাংশই ব্যয় করতেন বাঙালি প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তাদের সম্পর্ক ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব থেকে পারিবারিক বন্ধুত্বে উন্নীত হয়েছিল। হকিংয়ের জ্যেষ্ঠ ছেলে রবার্ট, কন্যা লুসি এবং কনিষ্ঠ ছেলে থিমোতি জামাল নজরুল ইসলামের সঙ্গ খুব পছন্দ করতেন। জামাল নজরুল ইসলামের দুই মেয়ে সাদাফ যাস সিদ্দিকি ও নার্গিস ইসলাম ছিলেন তাদের খুব আদরের। সাদাফ যাসের আমন্ত্রণে লুসি ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে লিট ফিস্টে যোগ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ এসেছিলেন। অর্থশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন ছিলেন জামাল নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে এলে বন্ধু জামাল নজরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করার জন্য চট্টগ্রাম চলে গিয়েছিলেন। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী আবদুস সালাম বাংলাদেশে এলে বিমান বন্দরে নেমে বলেছিলেন, জেএন ইসলামকে খবর দিন। ওই সফরে জেএন ইসলামকে একটা পদকও দিয়েছিলেন প্রফেসর আবদুস সালাম। উল্লেখ্য, বয়সে জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন হকিংয়ের সিনিয়র কিন্তু আবদুস সালাম এবং অমর্ত্য সেনের জুনিয়র।
কেম্ব্রিজের শিক্ষক প্রফেসর সুসানার ভাষায়, ‘বিজ্ঞানময়তা বিবেচনায় হকিংয়ের অ্যা ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম-এর চেয়ে অনেক গুণ কার্যকর এবং বিজ্ঞানানুগ হচ্ছে জেএন ইসলামের দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স।’ বলা হয়, ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম এক কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। বিজ্ঞানগুরুত্বে যদি এটি হয়ে থাকে, তাহলে জেএন ইসলামের ‘দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স’ একশ কোটি কপি বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু হয়নি।
কেন? কারণ প্রচার হয়নি। আমরা করিনি। জেএন ইসলাম মুসলিম, জেএন ইসলাম তৃতীয় বিশ্বের লোক। তাই পাশ্চাত্যে যথাগুরুত্ব পাননি। জেএন ইসলামের দেশের লোকই তাকে তুলে ধরতে পারেনি, অন্যরা কেন করবে? জেএন ইসলামের লেখা এবং ক্যাম্ব্রিজ থেকে প্রকাশিত ‘রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’ বইটাকে বলা হয় আধুনিক বিজ্ঞানের একটি অদ্বিতীয় বই। সেটা নিয়ে অধিকাংশ বাঙালি কিছুই জানে না। নিজের ঘরের মানুষের কৃতিত্বের খবর যদি ঘরের মানুষ না রাখে তাহলে বাইরের লোকে রাখবে কেন? জেএন ইসলামের ‘দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স’ ছাড়া আর কোনো বাঙালির বই হিব্রæ ভাষায় অনূদিত হয়নি। তার তিনটি বই এবং দুটি আর্টিক্যাল ক্যাম্ব্রিজ, অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, প্রিস্টনসহ পৃথিবীর শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। অথচ বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় কি না আমার জানা নেই। এ হিসেবেও জামাল নজরুল ইসলাম হকিংয়ের চেয়ে অনেক বড়ো বিজ্ঞানী।
জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন আপাদমস্তক দেশপ্রেমিক। নিজের আয় থেকে অর্থ জমিয়ে দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ বন্ধের উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন। সর্বোপরি, বিদেশে সহস্র পাউন্ডের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে জামাল নজরুল ইসলাম বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন। শুধু তাই নয়, মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশে ফেরার আগে জামাল নজরুল ইসলামের পরামর্শ চাইলে তিনি, জাফর ইকবালকে দ্রুত দেশে ফেরার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন দেশের জন্য কিছু করার সুযোগ পাবেন। দেশে ফিরে নিজের অধ্যয়নভূমি (জন্মস্থান ঝিনাইদহ) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ৩০০০ টাকার বৃত্তিতে কাজ শুরু করেন। ভেবেছিলেন দেশ তাঁকে মূল্যায়ন করতে পারবে, পারলেও করেনি। আমরা বাঙালিরা তাকে ওই তিন হাজার টাকা ছাড়া আর কিছুই দিতে পরিনি। তিনি যদি দেশে না আসতেন তাহলে পৃথিবী অনেক কিছু পেত। স্বার্থপর জেএন ইসলাম নিজের দেশের জন্য পৃথিবীকে বঞ্চিত করেছেন। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ তিনি ইন্তেকাল করেন।