স্টিফেন উইলিয়াম হকিং, গ্যালিলিও গ্যালিলাই-এর মৃত্যুর ঠিক তিনশ’ বছর পরে, ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি অক্সফোর্ডে জন্মগ্রহণ করেন। স্টিফেন উইলিয়াম হকিং বিশিষ্ট ইংরেজ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ হিসেবে বিশ্বের সর্বত্র পরিচিত ব্যক্তিত্ব। তাঁকে বিশ্বের সমকালীন তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের মধ্যে অন্যতম হিসাবে বিবেচনা করা হয়। হকিং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান অধ্যাপক (স্যার আইজ্যাক নিউটনও একসময় এই পদে ছিলেন হিসেবে ১ অক্টোবর, ২০০৯ তারিখে অবসর নেন। এছাড়াও তিনি কেমব্রিজের গনভিলি এবং কেয়াস কলেজের ফেলো হিসেবে কর্মরত আছেন। শারীরিকভাবে ভীষণরকম অচল এবং এএলএসের (যা একপ্রকার মোটর নিউরন রোগ) জন্য ক্রমাগতভাবে সম্পূর্ণ অথর্বতার দিকে ধাবিত হওয়া সত্ত্বেও বহু বছর যাবত তিনি তাঁর গবেষণা কার্যক্রম সাফল্যের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছেন।
পদার্থবিজ্ঞানে হকিংয়ের দুটি অবদানের কথা সবচেয়ে বেশি স্বীকৃত। প্রথম জীবনে সতীর্থ রজার পেনরাজের সঙ্গে মিলে সাধারণ আপেক্ষিকতায় সিংগুলারিটি সংক্রান্ত তত্ত্ব। হকিং প্রথম অনিশ্চয়তার তত্ত্ব ব্ল্যাক হোলের ঘটনা দিগন্দে প্রয়োগ করে দেখান , যে ব্ল্যাক হোল থেকে বিকিরিত হচ্ছে কণা প্রবাহ। এই বিকরণ এখন হকিং বিকিরণ নামে (অথবা কখনো কখনো বেকেনস্টাইন-হকিং বিকিরণ) অভিহিত। প্রায় ৪০ বছর ধরে হকিং তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের চর্চা করছেন। লিখিত পুস্তক এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির থেকে হকিং একাডেমিক জগতে যথেষ্ট খ্যাতিমান হয়ে উঠেছেন। তিনি রয়েল সোসাইটি অব আর্টসের সম্মানীয় ফেলো এবং পন্টিফিকাল একাডেমি অব সায়েন্সের আজীবন সদস্য ২০১৪ সালে তাকে নিয়ে একটি মুভি তৈরি হয়, নাম থিওরী অব এভরিথিং।
জীবনী : হকিংয়ের বাবা ড. ফ্রাঙ্ক হকিং একজন জীববিজ্ঞান গবেষক ও মা ইসোবেল হকিং একজন রাজনৈতিক কর্মী। হকিংয়ের বাবা-মা উত্তর লন্ডনে থাকতেন, লন্ডনে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা চলাকালীন হকিং গর্ভে আসার পর নিরাপত্তার খাতিরে তারা অক্সফোর্ডে চলে যান। হকিংয়ের জন্মের পর তারা আবার লল্ডনে ফিরে আসেন। ফিলিপ্পা ও মেরি নামে হকিংয়ের দুই বোন রয়েছে। এছাড়া হকিং পরিবারে এডওয়ার্ড নামে এক পালকপুত্রও ছিল। হকিংয়ের বাবা-মা পূর্ব লন্ডনে বসাবস করলেও ইসাবেল গর্ভবতী থাকার সময় তারা অক্সফোর্ডে চলে যান। সে সময় জার্মানরা নিয়মিতভাবে লন্ডনে বোমাবর্ষণ করত। হকিংয়ের একটি প্রকাশনা থেকে জানা গেছে তাদের বসতবাড়ির কয়েকটি গলি পরেই জার্মানির ভি-২ মিসাইল আঘাত হানে।
স্টিফেনের জন্মের পর তাঁরা আবার লন্ডনে ফিরে আসেন। সেখানে স্টিফেনের বাবা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর মেডিক্যাল রিসার্চের প্যারাসাইটোলজি বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।
বিজ্ঞানে হকিংয়ের সহজাত আগ্রহ ছিল। হকিংয়ের বাবার ইচ্ছে ছিল হকিং যেন তার মতো ডাক্তার হয়। কিন্তু হকিং গণিত পড়ার জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু যেহেতু সেখানে গণিতের কোর্স পড়ানো হতো না, সেজন্য হকিং পদার্থবিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়া শুরু করেন। সে সময়ে তার আগ্রহের বিষয় ছিল তাপগতিবিদ্যা, আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত স্টিফেন হকিং
তত্ত্বীয় কসমোলজি আর কোয়ান্টাম মধ্যাকর্ষ হকিংয়ের প্রধান গবেষণা ক্ষেত্র। ১৯৬০ এর দশকে ক্যামব্রিজের বন্ধু ও সহকর্মী রজার পেনরোজের সঙ্গে মিলে হকিং আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব থেকে একটি নতুন মডেল তৈরি করেন। সেই মডেলের ওপর ভিত্তি করে ১৯৭০ এর দশকে হকিং প্রথম তাদের (পেনরোজ-হকিং তত্ত্ব নামে পরিচিত) তত্ত্বের প্রথমটি প্রমাণ করেন। এই তত্ত্বগুলো প্রথমবারের মতো কোয়ান্টাম মহাকর্ষে এককত্বের পর্যাপ্ত শর্তসমূহ পূরণ করে। আগে যেমনটি ভাবা হতো এককত্ব কেবল একটি গাণিতিক বিষয়। এই তত্ত্বের পর প্রথম বোঝা গেল, এককত্বের বীজ লুকানো ছিল আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে।
১৯৮৫ সালে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন হকিং? ১৯৮৫ সালের গ্রীষ্মে জেনেভার ঈঊজঘ এ অবস্থানকালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন বিজ্ঞানী। চিকিৎসকরাও তাঁর কষ্ট দেখে একসময় লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সম্প্রতি হকিং-এর জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে এক তথ্যচিত্র। সেখানেই এই তথ্য জানিয়েছেন হকিং। তিনি বলেছেন, ‘নিউমোনিয়ার ধকল আমি সহ্য করতে পারিনি, কোমায় চলে গিয়েছিলাম? তবে চিকিৎসকরা শেষ অবধি চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন, হাল ছাড়েননি?’ কিন্তু চেষ্টা সত্ত্বেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে চিকিৎসকরা হকিংয়ের স্ত্রী জেনকেও লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম বন্ধ করে দেয়ার কথা জানান? তবে সে প্রস্তাবে অবশ্য রাজি হননি জেন। পাঁচ দশক ধরে মোটর নিউরোনের ব্যাধির শিকার জগৎখ্যাত এই পদার্থবিদ। বিশেষজ্ঞদের মত, এই রোগে আক্রান্তরা বড়জোর বছর পাঁচেক বাঁচেন। তথ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে রোগের সঙ্গে হকিং-এর লড়াইয়ের কাহিনী। বেঁচে থাকার জন্য হকিংয়ের আর্তিও ফিরে এসেছে বারে বারে। গত দু’দশকের সঙ্গী জেন বলেছেন, ‘হকিংয়ের এই ব্যাধি আমাদের ব্যক্তিজীবনের ব্ল্যাকহোল। যে গহ্বরে বাঁচার আশা হয়ত তলিয়ে যেতে পারত অনেক আগেই? কিন্তু সম্পর্কে আস্থা আর পরস্পরের প্রতি অগাধ ভালবাসা তলিয়ে যেতে দেয়নি।’ তথ্যচিত্রে কর্মজীবনের চেয়ে হকিংয়ের ব্যক্তিজীবনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় বিজ্ঞানীদের একাংশ অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের দাবি, বিজ্ঞানে অবদান ছাড়া হকিংয়ের জীবনকে দেখানো মানে বকলমে তাঁকেই গুরুত্বহীন করে তোলা। তবে তথ্যচিত্রে এমন কিছু তথ্যও পরিবেশিত হয়েছে, যা হকিংয়ের একটা অদেখা দিক আমাদের সামনে তুলে ধরে?
স্টিফেন হকিং এর মতে যে তিনটি কারণে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে মানব সভ্যতা
ব্ল্যাক হোল এবং গ্র্যাভিটেশনাল সিঙ্গুলারিটির ব্যাপারে গবেষণা করে বিখ্যাত হলেও, বর্তমানে স্টিফেন হকিং মানব সভ্যতার ব্যাপারে তার বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করে চলেছেন। তার মতে, মানব সভ্যতা ধ্বংস করে দিতে পারে এই তিনটি ঘটনা।
১) আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স
গবেষকদের একটি দল আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের ব্যাপারে শঙ্কিত এবং এদের দলেই আছেন স্টিফেন হকিং। তাদের ধারণা, এই বুদ্ধিমত্তা এক সময়ে মানুষকে ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং মানুষের ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। কিন্তু অনেক গবেষকেরা আবার মনে করেন, এমন শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরির প্রযুক্তি এখনো মানুষের নেই।
২) মানব আগ্রাসন
আমাদের তৈরি করা যন্ত্রই আমাদের ধ্বংস করে ফেলতে পারে এমনটাই নয়, বরং আমরা নিজেরাই নিজেদের বিলুপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারি। হকিং এর মতে, মানুষের সবচাইতে বড় ত্রুটি হলো আগ্রাসন। গুহামানবদের সময়ে আগ্রাসনের মনোভাব আমাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করতো, কিন্তু এখন এর কারণেই আমাদের ধ্বংস আসন্ন। উদাহরন হিসেবে, একটি বড় ধরণের নিউক্লিয়ার যুদ্ধ খুব কম সময়েই সভ্যতা ধ্বংস করে দিতে পারে এবং পৃথিবী থেকে মুছে ফেলতে পারে মানুষের চিহ্ন। এ কারণে তিনি বিশ্বাস করেন, মহাশূন্যে মানুষের জন্য নতুন বসতি খোঁজাটা জরুরি। এতে ভবিষ্যতে মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটা সম্ভব হবে।
৩) ভিনগ্রহের প্রাণী
২০১০ সালে হকিং বলেন, যদি পৃথিবীর বাইরে বুদ্ধিমান প্রাণী থেকেও থাকে, তবে এটা ভাবার কারণ নেই যে তারা মানুষের প্রতি বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করবে। বরং তারা হতে পারে বেশ বিপজ্জনক। তারা পৃথিবীতে কলোনি সৃষ্টি করতে গিয়ে মানব সভ্যতা ধ্বংস করে ফেলতে পারে অথবা পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ সব তুলে নিয়ে যেতে পারে।