খালেদ মোশাররফ একজন বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধা ও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে খালেদ মুক্তিবাহিনীর ২ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার এবং 'কে-ফোর্স'-এর সর্বাধিনায়ক ছিলেন। বীরত্বের জন্য তাঁকে বীর উত্তম পদক দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর ৩ তারিখে তিনি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। এর মাত্র ৩ দিন পরে ৭ নভেম্বর তারিখে তিনি এক পাল্টা অভ্যুত্থানে নিহত হন।
জন্ম :
খালেদ মোশাররফ জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানার মোশাররফগঞ্জ গ্রামে ১৯৩৭ সালের ১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন
পরিবার :
ভাই রাশেদ মোশাররফ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর পক্ষে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্য এবং ভূমি প্রতিমন্ত্রী হন।
শিক্ষা :
তিনি কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে মেট্রিক পাশ করেন এবং ১৯৫৫ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাশ করেন। অতঃপর তিনি পাকিস্তানের কাকুল মিলিটারি একাডেমীতে যোগ দেন।
সেনাবাহিনীতে মোশাররফ :
১৯৫৭ সালে সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভের পর প্রায় আট বছর (১৯৫৭-১৯৬৫) তিনি বিভিন্ন সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় খালেদ মোশাররফ চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের অ্যাডজুডেন্ট হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। যুদ্ধের পর তিনি কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেখান থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর তিনি মেজর হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি কোয়েটা স্টাফ কলেজ থেকে পি.এস.সি. ডিগ্রি লাভ করেন এবং তাকে ব্রিগেড মেজর হিসেবে খারিয়াতে ৫৭- ব্রিগেডে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁর যখন জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে সেনা-প্রশিক্ষণে যাওয়া কথা, তখন ১৯৭০ সালের মার্চে তাঁকে ঢাকা বদলি করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ :
২৪ মার্চ ১৯৭১ সালে খালেদ মোশাররফকে কুমিল্লাতে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ২৬ মার্চ মৌলভীবাজারের শমসেরনগরে তিনি ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই কোম্পানি সৈনিক নিয়ে অবস্থান করছিলেন। ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার খবর পেয়ে তিনি বিদ্রোহ করেন এবং সেই রাতে তাঁর বাহিনী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন। পরদিন ২৭ মার্চ সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছালে তাঁর বাহিনী এবং সেখানে আগে থেকে অবস্থানরত মেজর শাফায়াত জামিলের বাহিনী সম্মিলিত হয়। ইতোমধ্যেই তাঁর বেতার নির্দেশ পেয়ে শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে বাঙালি সৈনিকরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানরত পাঞ্জাবি সৈনিকদের আটক করেন। খালেদ চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসারের দ্বায়িত্ব নেন। পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি তাঁর বাহিনীর অফিস ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে তেলিপাড়া চা বাগানে সরিয়ে নেন।
গেরিলা যোদ্ধা শফি ইমাম রুমী সেক্টর-২ এ খালেদ মোশাররফের অধীনে মেলাঘরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন। জুন মাসের শেষের দিকে দুই নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ এর একটি চিঠি নিয়ে শাহাদাত চৌধুরী ও হাবিবুল আলম আসেন শরীফ ইমামের বাড়িতে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চলাচল ব্যাহত করার উদ্দেশ্যে খালেদ মোশাররফ তাঁর কাছে বাংলাদেশের সেতু ও কালভার্টের ব্যাপারে তথ্য চেয়ে পাঠান। শরীফ ইমাম ব্রিজের ঠিক কোন কোন স্থানে বিস্ফোরক বেঁধে ওড়ালে সেতু ভাঙবে অথচ কম ক্ষতি হবে অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সহজে মেরামত করা যাবে, সেভাবে বিস্তারিত তথ্য দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সফল প্রতিরোধ করতে করতে মধ্য এপ্রিলে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবিরাম বিমান আক্রমণের শিকার হন, ফলে তিনি ত্রিপুরা রাজ্যে অবস্থান নেন। মুজিবনগর সরকার তাঁকে ২ নং সেক্টরের দায়িত্ব দেয়। যুদ্ধের সময় খালেদ মোশাররফ লেফটেনেন্ট কর্নেলের পদে উন্নীত হন। ২৩ অক্টোবর খালেদ মোশাররফ মাথায় গুলি লেগে মারাত্মক আহত হন এবং লক্ষ্ণৌ সামরিক হাসপাতালে দীর্ঘ চিকিৎসা লাভের পর সুস্থ হন।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় :
যুদ্ধের পর খালেদ মোশাররফ ঢাকা সেনা সদর দপ্তরে স্টাফ অফিসার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। পরে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চীফ অব জেনারেল স্টাফ হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে খালেদ মোশাররফকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নিহত হবার পর ৩ নভেম্বর, ১৯৭৫ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন। ঐ সময় তিনি সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করেন এবং নিজেকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে সেনাপ্রধান হন । ঠিক তিন দিন পর ৭ নভেম্বর আরেকটি পাল্টা অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হন।
হত্যা :
৬ নভেম্বর ১৯৭৫, খালেদ মোশাররফ এবং তাঁর দুই সহকর্মী কর্নেল নাজমুল হুদা এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ.টি.এম. হায়দার ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যান। পরদিন সকাল ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখ সকাল ১১টায় ২য় ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির এর একজন কর্মকর্তার নির্দেশে (কথিত আছে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ এই নির্দেশ দেন, যাঁকে শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার দায়ে ২৮ জানুয়ারি ২০১০ তারিখে ফাঁসি দেয়া হয়), ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর কয়েকজন কর্মকর্তা খালেদ মোশাররফ এবং তাঁর দুই সহকর্মীকে হত্যা করেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা :
বীর উত্তম