গত প্রায় এক দশকে রাজশাহী অঞ্চলে টেলিফোন সংযোগ নেমে এসেছে অর্ধেকে। এছাড়া বিল বকেয়া পড়ে রয়েছে ৩ কোটি ৯৭ লাখ ৫০ হাজার ৬০৭ টাকা। এর মধ্যে কেবল শীর্ষ ১০০ বিল খেলাপির কাছেই বকেয়া পড়েছে ৩৫ লাখ ৮৭ হাজার ৮৫৯ টাকা।
গ্রাহকরা বলছেন, দীর্ঘসময় ধরে সংযোগ বিকল থাকছে। অভিযোগ দিয়েও কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করছেন অনেকেই। এতেই টান পড়ছে রাজস্বে। যদিও বিষয়টি স্বীকার করছে না রাজশাহী বিটিসিএল।
তবে এ পরিস্থিতি ভাবনায় ফেলেছে খোদ বিটিসিএলকেই। কারণ অনুসন্ধানে রাজশাহী টেলিযোগাযোগ অঞ্চল সরেজমিন ঘুরে গেছেন বিটিসিএলের উপপরিচালক (তদন্ত) আবুল হোসেন। ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজশাহী টেলিযোগাযোগ অঞ্চলের আওতাধীন রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলা ঘুরে গেছেন তিনি।
এদিকে দীর্ঘসময় ধরে গ্রাহকের অভিযোগ ঝুলে থাকার খবর নেই রাজশাহী টেলিযোগাযোগ অঞ্চলের সদর দফতরে। লাইনম্যানদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সর্বোচ্চ তিন দিনের মধ্যেই তারা বিকল সংযোগগুলো মেরামত করে দেন। পালা করে কাজ করেন কর্মীরা।
বিষয়টি নিশ্চিত করে বিটিসিএল রাজশাহীর প্রধান কর্মাধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পরপরই তা সংশ্লিষ্ট শাখা লাইনম্যানদের জানিয়ে দেয়। তারাই গ্রাহকদের বিকল সংযোগ দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেরামত করে দেন। কেবল মুঠোফোনের সহজলভ্যতায় টেলিফোন সংযোগ কমছে বলে দাবি করেন এই বিটিসিএল কর্মকর্তা।
জনবল সংকটের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, রাজশাহীতে অনুমোদিত জনবল ৭০৮। এর বিপরীতে নিয়মিত জনবল রয়েছে মাত্র ১৪৬। ৮৩ জন ওয়ার্কচার্জড এবং ৬০ জন মাস্টাররোল কর্মী রয়েছেন এখানে। দীর্ঘদিন ধরেই এ অবস্থা চলে আসছে। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সময়োপযোগী গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করতে বিটিসিএল কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
বিটিসিএল রাজশাহীর প্রধান কর্মাধ্যক্ষের দফতর জানিয়েছে, ২০১০ সালে বছরের শুরুতে সচল টেলিফোন সংযোগ ছিলো ৪১ হাজার ৩৬০। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে তা গিয়ে দাঁড়িছে ২৭ হাজার ৪৮০তে। বন্ধ হয়ে গেছে ১৩ হাজার ৮৮০ সংযোগ।
এ ক’বছরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সবেচেয় বেশি টেলিফোন সংযোগ বন্ধ হয়েছে ২০১৫ সালে। ৫ হাজার ৩৮০টি। সেবছর নতুন সংযোগ দেয়া হয়েছে এক হাজার ২৮৩টি। অন্যদিকে ২০১০ সালে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৮২০টি নতুন সংযোগ দেয়া হলেও ওই বছরই বন্ধ হয়ে যায় ৩ হাজার ১২টি সংযোগ। সর্বশেষ ২০১৭ সালে ২ হাজার ৮২৮টি সংযোগ বন্ধ হলেও মাত্র ৭২৮টি নতুন সংযোগ চালু হয়েছে।
অন্যদিকে বিটিসিএল অঞ্চলিক হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয় জানিয়েছে, ২০০৮-২০০৯ অর্থ বছর থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দশ বছরে রাজশাহী টেলিযোগাযোগ অঞ্চলে জারিকৃত টেলিফোন বিল ছিল ১২৩ কোটি ৭৯ লাখ ৫২ হাজার ৮৮৬ টাকা। এর মধ্যে আদায় হয়েছে ১১৯ কোটি ৮২ লাখ ২ হাজার ২৭৯ টাকা। এখনও বকেয়া টেলিফোন বিল ৩ কোটি ৯৭ লাখ ৫০ হাজার ৬০৭ টাকা। এক দশকের মধ্যে কেবল ২০১৫ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত এবং ২০০৮-২০০৯ এ চার অর্থবছরেই বাড়তি বিল আদায় হয়েছে। বাকি ছয় অর্থ বছরে অনাদায়ী থেকে গেছে মোটা অংকের বিল।
এদিকে, এ অঞ্চলের শীর্ষ একশ বিল খেলাপীর কাছেই পড়ে রয়েছে ৩৫ লাখ ৮৭ হাজার ৮৫৯ টাকা। এর মধ্যে রাজশাহীর ৪০ বিল খেলাপির কাছে পাওনা ১৬ লাখ ৯ হাজার ২৬৬ টাকা। এছাড়া পাবনার ২১ জনের কাছে ৮ লাখ ২৮ হাজার ৩৪ টাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ২২ জনের কাছে ৫ লাখ ৪ হাজার ৮০০ টাকা, ঈশ্বরদীর ১০ জনের কাছে ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৪৩৯ টাকা এবং নাটোরের ৬ জনের কাছে এক লাখ ৬০ হাজার ৩২০ টাকা টেলিফোন বিল পাওনা রয়েছে।
তালিকার শীর্ষ বিল খেলাপি বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য ও সাবেক জেলার সভাপতি অ্যাডভোকেট নাদিম মোস্তফার দুটি সংযোগে মোট বকেয়া বিল ৫ লাখ ৮৫ হাজার ৯৪৫ টাকা। এক লাখ ৮৭ হাজার ৫৯৫ টাকা বিল বকেয়া রয়েছে পাবনার ঈশ্বরদী স্টেশন রোডের বাসিন্দা ইয়াকুব হোসেনের। রাজশাহী নগরী সুজানগর এলাকার বাসিন্দা আক্তারুজ্জামানের বকেয়া বিলের পরিমাণ এক লাখ ৩৬৭ টাকা। এক লাখ ৭১৫ টাকা বিল বকেয়া পাবনার কলেজপাড়া এলাকার নজরুল ইসলামের।
এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. শাহরিয়া ইসলামের ৫১ হাজার ৭২২ টাকা, রাজশাহী নগরীর শেখপাড়ার শরিফুল ইসলামের ৪৯ হাজার ৫০৬ টাকা, নাটোরের প্রিমিয়াম ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ৪৫ হাজার ২৪ টাকা, জেলার চকরামপুর এলাকার মোহাম্মদ আলীর ৪২ হাজার ১৬৯ টাকা, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও বুলনপুর এলাকার বাসিন্দা আবুল হাসেমের ৩০ হাজার ৫৭৯ টাকা, উপশহরের গোলাম আরিফের ২৭ হাজার ৭২৯ টাকা এবং এটিএন বাংলার রাজশাহী প্রতিনিধি সুজাউদ্দিন ছোটনের ১৩ হাজার ৭৪২ টাকা টেলিফোন বিল বকেয়া রয়েছে।
বকেয়া বিল আদায়ে আইনত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জনিয়েছেন বিটিসিএল অঞ্চলিক হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, বকেয়া বিল আদায়ে ম্যাজিস্ট্রিয়াল নোটিশসহ দফায় দফায় নোটিশ দেয়া হয়েছে গ্রাহকদের। কিন্তু তাতে সাড়া না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলা এখন চলমান। তবে বকেয়া বিল আদায়ে নিজেদের সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার কথা জানান এই কর্মকর্তা।