শহীদুল্লা কায়সার একজন বাঙালি লেখক ও বুদ্ধিজীবী। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লা । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তার স্থানীয় সহযোগী আল-বদরের হাতে অপহৃত হন। ধারণা করা হয় যে, অপহরণকারীদের হাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন :
শহীদুল্লা কায়সার ১৯২৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ফেনী জেলার মাজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পুরো নাম আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর বাবার নাম মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ্ এবং মায়ের নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন ৷ 'সরকারি মডেল স্কুলে' এবং পরে 'মাদরাসা-ই-আলিয়া'র অ্যাংলো পার্সিয়ান বিভাগে ভর্তি হন তিনি। ১৯৪২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর উচ্চতর শিক্ষার জন্য তিনি ভর্তি হন 'প্রেসিডেন্সি কলেজে'৷ ১৯৪৬ সালে তিনি এখান থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন এবং অর্থনীতিতে এমএ পড়ার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ৷ একই সাথে তিনি 'রিপন কলেজে' (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ আইন কলেজ) আইন বিষয়ে পড়াশুনা শুরু করেন৷ ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তাঁর বাবা ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এমএ ভর্তি হন। তবে এ ডিগ্রি লাভ করার আগেই পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটান।
কর্মজীবন :
শহীদুল্লা কায়সার ১৯৫৬ সালে কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পরিচালিত 'সাপ্তাহিক ইত্তেফাক' পত্রিকায় যোগদান করেন৷ এভাবেই তিনি যুক্ত হন সাংবাদিকতায়। পরবর্তীতে তিনি ১৯৫৮ সালে 'দৈনিক সংবাদ'-এর সম্পাদকীয় বিভাগে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন৷ ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক আইন জারি হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ১৪ অক্টোবর তাঁকে গ্রেফতার করা হয়৷ জননিরাপত্তা আইনে তাঁকে এ পর্যায়ে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত আটক রাখা হয়৷ মুক্তি লাভ করেই তিনি 'দৈনিক সংবাদ'-এর সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দেন৷ 'সাপ্তাহিক ইত্তেফাক' পত্রিকা থেকে সাংবাদিক জীবনের হাতেখড়ি হলেও তাঁর সাংবাদিক জীবনের সমস্ত কৃতিত্ব ও পরিচিতি 'দৈনিক সংবাদ'-কে ঘিরে আবর্তিত৷
রাজনৈতিক ভূমিকা :
শহীদুল্লা কায়সার সমসাময়িক রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। বামরাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততার কারণে তিনি একাধিকবার কারাবরণ করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি দেশপ্রেমিক ছদ্মনামে রাজনৈতিক পরিক্রমা ও বিশ্বকর্মা ছদ্মনামে বিচিত্রা কথা শীর্ষক উপ-সম্পাদকীয় রচনা । আমৃত্যু তিনি কমিউনিস্ট পরিচয় বহন করেছেন।
সাহিত্যকর্ম :
সারেং বৌ, উপন্যাস (১৯৬২) (চলচ্চিত্র রূপ ১৯৭৮)
সংশপ্তক, উপন্যাস (১৯৬৪)
রাজবন্দীর রোজনামচা, স্মৃতিকথা (১৯৬২)
পেশোয়া থেকে তাসখন্দ(১৯৬৬) ভ্রমণবৃত্তান্ত
পুরস্কার তালিকা :
আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬২)
বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬২)
স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৮)
ব্যক্তিগত জীবন :
শহীদুল্লা কায়সার দুইবার বিয়ে করেছিলেন। তিনি প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যমন্ত্রী ও চিকিৎসক আর আহমেদের কন্যা জোহরা খাতুনকে বিয়ে করেন। বিবাহবিচ্ছেদের পরে শহীদুল্লা কায়সার ১৯৬৯ সালে পান্না চৌধুরীকে বিয়ে করেন। পান্না কায়সার ১৯৯৬-২০০১ সালের জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের একজন সাংসদ ছিলেন। তাঁদের দুইটি সন্তান, অমি কায়সার ও শমী কায়সার। শমী টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনেত্রী হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
মৃত্যু :
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আলবদর বাহিনীর কজন সদস্য তাঁকে তাঁর বাসা ২৯ বি কে গাঙ্গুলী লেন থেকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তিনি আর ফেরেন নি।