গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে জ্বর। অনেকের মৃত্যুও ঘটেছে। এই জ্বরের কারণ অনেক ক্ষেত্রেই ডেঙ্গু। রক্তের রিপোর্টে এনএস ওয়ান আর আইজি এম পজিটিভ হলে ডাক্তারেরা সেই জ্বরকে ডেঙ্গু বলে নির্দেশ করছেন।
বৈজ্ঞানিক তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গু এক ধরণের মশা বাহিত ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে রোগ। এই প্রজাতিভুক্ত মশা ডেঙ্গুর সাথে চিকুংগুনিয়া ইত্যাদি রোগেরও বাহক। বৃষ্টি, গুমোট গরম এবং খারাপ জল নিকাশি ব্যবস্থা এই মশার বিস্তারের কারণ।
গত কয়েক দশকে সারা পৃথিবীতে এই রোগ নাটকীয় ভাবে বেড়েছে।
ডেঙ্গু জ্বর হওয়া বেশ কিছু রোগির মধ্যে সিভিয়ার ডেঙ্গু বা ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার নামে মারাত্মক রোগলক্ষণ দেখা যায়। যে সিভিয়ার ডেঙ্গুর কথা বলা হল সে’টি বিশেষ করে ভারতের মত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বয়স্ক ও শিশুদেরও অসুস্থতা, হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর উল্লেখযোগ্য কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চারটি আলাদা সেরোটাইপের ভাইরাস ডেঙ্গু রোগ ঘটায়। এবং একটি ডেঙ্গু জ্বর থেকে সেরে ওঠার পর অন্য সেরোটাইপের ভাইরাসের আক্রমণে পুনরায় ডেঙ্গু জ্বর হলে সে’টি সিভিয়ার ডেঙ্গুতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
ডেঙ্গুর বা সিভিয়ার ডেঙ্গুর জন্য আলাদা কোনও চিকিৎসা জানা নেই। কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় রোগ ধরতে পারলে আর প্রকৃত চিকিৎসা ব্যবস্থার সুযোগ নিতে পারলে এই রোগে মৃত্যুর হার শতকরা কুড়ি থেকে এমনকি শতকরা একেরও নীচে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
ডেঙ্গুর প্রতিরোধ এবং প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব একমাত্র এর বাহক মশাকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এক ধরণের ডেঙ্গু ভ্যাকসিন কিছু দেশে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তা’ আমাদের এ’খানে পাওয়া যায় না। এই রোগের মূল লক্ষণ হল প্রচণ্ড জ্বর সমেত ইনফ্লুয়েঞ্জার মত অসুস্থতা।
ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত উপসর্গগুলি দেখা যায়-
ক) কয়েকদিনের জ্বর। কখনও কখনও খুবই তীব্র জ্বর
খ) মাথাব্যথা
গ) শরীর দুর্বলতা
ঘ) গায়ে হাত পায়ে এবং বিভিন্ন গাঁটে ব্যথা
ঙ) চোখের পেছনে ব্যথা
চ) বমি বমি ভাব, বমি
ছ) শরীরে জল কমে যাওয়া ইত্যাদি
কখনও কখনও জটিলতা সৃষ্টি হয়ে এই অসুখে মৃত্যু অবধি হতে পারে। সেই জটিল অবস্থাকেই বলা হয় সিভিয়ার বা অতি মারাত্মক ডেঙ্গু। যেখানে শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তপাত, জল কমে গিয়ে শক সিন্ড্রোম, মাল্টি অর্গান ফেইলিওর ইত্যাদি প্রাণঘাতী উপসর্গ দেখা দেয়।
উপরোক্ত উপসর্গ থাকলেই সেটা ডেঙ্গু এমন বলা যায় না।
তাই অবশ্যই রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে।
প্রাথমিক ভাবে রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে,
Complete Blood Count আর Dengue NS1 Antigen।
জ্বর শুরু হওয়ার 5 দিনের মধ্যে Dengue NS1 টেস্ট করাতে হবে। 5 দিন পেরিয়ে গেলে, Dengue IGM ( Elisa Method) টেস্টও করাতে হবে। রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট ডাক্তারকে দেখান।
রিপোর্ট আসা আর ডাক্তারের কাছে যাওয়ার মাঝখানের সময় যা করনীয় তা’ হল-
ক) নিয়মিত ORS মেশানো জল পান করতে হবে
খ) জ্বর হলে Paracetamol(জ্বর কমানোর ওষুধ) খেতে হবে
জ্বরের সময় সতর্কভাবে অন্য উপসর্গ কিছু দেখা যাচ্ছে কি না খেয়াল রাখতে হবে। জ্বরের সময় নিম্নলিখিত উপসর্গগুলির একটিও দেখা দিলে, রোগিকে হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত-
ক)বমি বমি ভাব
খ)প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া
গ) পেটে ব্যথা
ঘ)মাথা ঘোরা ভাব
ঙ) শরীরের কোথাও লাল রক্তের দানা দানা কিছু বেরনো
চ) চোখ হলুদ হওয়া
ছ) হঠাৎ করে পায়ের গোড়ালি, চোখের পাতা ফুলে যাওয়া
Aspirin জাতীয় ওষুধ জ্বরের সময় খাবেন না।
বাচ্চাদের ডেঙ্গু হলে, করণীয় প্রায় একই। শিশুরা নিজেরা বলতে অক্ষম তাই সতর্কতার মাত্রা বাড়াতে হবে।
বড়দের মতোই বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও পূর্ব বর্ণিত উপসর্গগুলি খেয়াল রাখতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাচ্চাদের প্রস্রাবের পরিমাণ নজরে রাখা। ডেঙ্গু হওয়া কোন শিশু যদি দিনে 3 বারের কম প্রস্রাব করে তাকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এছাড়া বড়দের মতোই বাচ্চাদেরও ORS জল খাওয়াতে হবে।
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে Paracetamolএর ডোজ গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চার আনুমানিক ওজন জেনে 10 থেকে15 mg প্রতি KG ওজনের জন্য এই হিসাবে Paracetamol বাচ্চাদের দেওয়া হয়। Paracetamol ট্যাবলেট বাচ্চাদের দিতে পারবেন না। বাচ্চাদেরকে Paracetamol Syrup দিতে হবে। ওজন অনুযায়ী পরিমাণ মেপে বুঝে খাওয়ান। প্রয়োজনে 4 থেকে 6 ঘণ্টা পরপর দিতে পারা যায়। কিন্তু সারা দিনে মানে চব্বিশ ঘণ্টায় পাঁচবারের বেশি না দেওয়াই বাঞ্ছনীয়।
ডেঙ্গু হলেই শরীর রক্ত দিতে হবে তা’ নয়।
ডেঙ্গুতে প্লেট্লেট্ কমে, কিন্তু তার জন্য নিয়মিত প্লেট্লেট্ জোগানোর প্রয়োজন নেই।
যদি প্লেটলেট খুব নীচে নেমে যায়, বা যদি শরীরের কোন অংশ থেকে রক্তক্ষরণ হয় (যেমন মাড়ি, পায়খানার দ্বার দিয়ে রক্তপাত, ত্বকের উপরের র্যাশ বা রক্ত বমি/কাশি) – তবেই চিকিৎসক নির্দেশ দিলে প্লেট্লেট্ দেওয়া হয়।
এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব এর বাহক মশার জন্ম ও বৃদ্ধি বন্ধ করতে পারলে তবেই। জমা জল, বিশেষ করে খোলা জায়গায় জমা জল, যেমন ডাবের খোলা, টব বা আমাদের চোখের সামনে বা আড়ালে আমাদের অতি পরিচিত এবং অবহেলিত পানি জমার জায়গাগুলো এই মশার আতুরঘর। এ’দের সতর্ক ও বাধ্যতামূলকভাবে জল শূন্য করতে হবে। মোটকথা খোলা জায়গায় জল জমিয়ে রাখা যাবে না।
মশা ও তার ডিম ও শুককীট মেরে ফেলার জন্য কেরোসিন স্প্রে আর সম্ভব হলে মশা নিরোধক রাসায়নিক স্প্রে ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করতে হবে।
ব্যক্তিগত ভাবে মশারি ব্যবহার শহর গ্রাম নির্বিশেষে বাধ্যতামূলক। বাড়িতে ও কাজের জায়গায় মশা নিরোধক স্প্রে, কয়েল, মলম ইত্যাদি সমস্ত সম্ভাব্য ব্যবস্থা নিয়ে মশার কামড় খাওয়া আটকাতে হবে।
এর জন্য প্রয়োজন সাংগঠনিক সমস্ত উদ্যোগ নিয়ে জনস্বাস্থ্যমূলক প্রচার ও মশা নিধনের জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ।
অতীব দুঃখের হলেও এ’টাই সত্যি যে বিপুল সংখ্যার মানুষ এই জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন, অনেক মৃত্যুও ঘটেছে।
কিন্তু তা’ হতে দিলে চলবে না। মানুষকেই সচেতন হতে হবে। আমাদেরই সচেতন ভাবে নিতে হবে মশা তথা ডেঙ্গু প্রতিরোধের উদ্যোগ।