“চকলেটের কিছু কথা” লেখাটিতে যেসমস্ত বিষয়াবলী সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে, তা নিম্নে একনজরে তুলে ধরা হলোঃ –
– চকলেট কী এবং কেন ?
– চকলেটের ইতিহাস
– চকলেট তৈরিতে ব্যবহৃত মূল উপাদানসমূহ
– আমাদের স্বাস্থ্যের উপর চকলেটের ভাল প্রভাবসমূহ
– আমাদের স্বাস্থ্যের উপর চকলেটের মন্দ প্রভাবসমূহ
– কোকো এবং চকলেটের পুষ্টি তথ্য
– কার্বোহাইড্রেট
– প্রোটিন
– ফ্যাট
– অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট
– থিয়োব্রোমিন
– ক্যাফিন
– ফিনাইলইথাইলঅ্যামিন
– চকলেটে কোন কোন মিনারেল বা খনিজ লবণ থাকে ?
– চকলেটে কোন কোন ভিটামিন থাকে ?
– চকলেটে ক্যালরি
– চকলেট কি মোটা হয়ে যাবার জন্য দায়ী ?
– ডার্ক চকলেট
– ডার্ক চকলেটের স্বাস্থ্যের প্রতি ভালো গুণাগুণ
– পৃথিবীর ১০টি সবচেয়ে জনপ্রিয় চকলেট ব্রান্ডের নাম
– চকলেট খাওয়া যাদের জন্য ক্ষতিকর
– তথ্যসূত্র
– চকলেট কী এবং কেন ?
চকলেট একটি প্রক্রিয়াজাত, সাধারণত মিষ্টি জাতীয় খাবার, যা কিনা মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় Theobroma cacao নামক গাছের বীজ – কোকো বীজ থেকে তৈরি করা হয়। কোকো গাছের বীজ তীব্র তিতা স্বাদযুক্ত হয় এবং এতে চকলেটের গন্ধ নিয়ে আসবার জন্য গাঁজন বা ফার্মেন্টেশন ঘটানো হয়। পরে চিনি যুক্ত করে মিষ্টি স্বাদ আনা হয়।
গাঁজনের পর কোকো বীজগুলো শুষ্ক, পরিষ্কার আর মচমচে হয়ে যায়। এরপর কোকো বীজের বাইরে খোসাটা সরিয়ে ফেলা হয় এবং একে ভেঙে গুড়ো করে কোকো পাউডার তৈরি করা হয়। বিশুদ্ধ চকলেট অমসৃণ হয়। কোকো পাউডারে পানি মিশিয়ে তৈরি করা হয় চকলেট লিকার। এই লিকার সাধারণত দুইটি ভাগে বিভক্ত, যথা – দানাদার কোকো এবং বাটার কোকো। মিষ্টিছাড়া তিতা চকলেটে প্রাথমিকভাবে এই দানাদার কোকো এবং বাটার কোকো বিভিন্ন অনুপাতে থাকে।
অনেক ধরণের মিষ্টি, চকলেট ক্যান্ডি, আইসক্রিম, বিস্কুট, কেক সহ বিভিন্ন ধরণের পিঠাতে চকলেট একটি সচরাচর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ঠান্ডা বা গরম দুই ধরণের তাপমাত্রাতেই আমরা চকলেটের স্বাদ পেতে পারি। পৃথিবীতে এটি একটি অনেক জনপ্রিয় ফ্লেভার বা গন্ধ।
– চকলেটের ইতিহাসঃ
প্রায় তিনহাজার বছর ধরে মেক্সিকো ও মধ্যআমেরিকার বহু এলাকাতে কোকো চাষ হয়ে আসছে। ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বে মেক্সিকোর মোকায়া নামক একটি অংশে চকলেটের পানীয় ব্যবহৃত হতো বলে জানা যায়। বেশির ভাগ মেসোআমেরিকান মানুষেরা চকলেটকে বলে থাকে “তিক্ত পানীয়”। যদিও কোকোর উৎপত্তি আমেরিকায়, তারপরও পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ চকলেট আজকাল পশ্চিম আফ্রিকায় উৎপাদিত হচ্ছে, যার অর্ধেকই আসছে আইভোরিকোস্ট থেকে।
– চকলেট তৈরিতে ব্যবহৃত মূল উপাদানসমূহঃ-
কি ধরণের চকলেট তৈরি হবে তার উপর ভিত্তি করে চকলেটে বিভিন্ন উপাদান ব্যবহৃত হয়। এটা অবশ্য আরও নির্ভর করে চকলেটের ব্রান্ডের উপর। তবে আজকাল আমরা যে চকলেট খাই তা মূলত মিষ্টিযুক্ত চকলেট এবং এই সমস্ত চকলেট কোকো পাউডার, কোকো বাটার, অন্যান্য ফ্যাট, এবং চিনি একত্রে মিশিয়ে তৈরি করা হয়। মিল্ক চকলেট, হাল্কা মিষ্টি চকলেট, মিষ্টিহীন চকলেট, ডার্ক চকলেট সব চকলেটেই সাধারণত বিভিন্ন ঘনমাত্রায় এবং বিভিন্ন হারে কোকো বীজের গুঁড়ো কোকো পাউডার ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সাদা চকলেটে মূলত কোকো বাটার বা কোকো ফ্যাট, চিনি আর দুধ ব্যবহৃত হয়। কোকো পাউডার সাদা চকলেটে ব্যবহৃত হয় না। বিভিন্ন ধরণের চকলেটে অন্যান্য সাধারণ উপাদানগুলি হচ্ছে দুধ, ক্রীম, বাটার, কোকো বাটার, মিল্ক ফ্যাট বা কঠিন মিল্ক, চিনি, কৃত্রিম মিষ্টি, রং এবং প্রিজারভেটিভ সমূহ। মিল্ক চকলেটগুলিতে চকলেটের সাথে অতিরিক্তভাবে পাউডার মিল্ক বা কন্ডেন্স মিল্ক যোগ করা হয়।
চকলেটে বিশেষ করে পাঁচটি উপাদান থাকে। এগুলি হলোঃ–
১। কোকো পাউডার ২। কোকো লিকার ৩। কোকো বাটার ৪। চিনি ৫। দুধ
এখানে কোকো পাউডার আর কোকো লিকার হচ্ছে চকলেটের প্রধান উপাদান। চিনির প্রয়োজনীয়তা এখানে চকলেটকে তার নিজস্ব মিষ্টিস্বাদ যুক্ত করে তোলার জন্য। এছাড়াও ভ্যানিলা নামক উপাদানটিও থাকতে পারে চকলেটে এবং ভ্যানিলার উপস্থিতি আমরা টের পাই চকলেটে ভ্যালিনার গন্ধের মাধ্যমে।
– আমাদের স্বাস্থ্যের উপর চকলেটের ভাল প্রভাবসমূহঃ
১। কোকো বা ডার্ক চকলেট আমাদের দেহের সংবহন তন্ত্রের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
২। বহু গবেষণার ফলাফল স্বরূপ দেখা গেছে যে, চকলেট আমাদের নির্দিষ্ট কিছু হৃদযন্ত্রের সমস্যা কমিয়ে আনতে পারে এবং মোটা-চিকন সব ধরণের ওজনের মানুষের রক্তচাপ কমাতে সক্ষম।
৩। চকলেট আমাদের অবধারণের বা বোধশক্তির ক্ষমতাকে উন্নত করতে পারে।
৪। ডার্ক চকলেট প্রাপ্তবয়স্কদের কোলেস্টেরল মাত্রা কমাতে পারে। যদিও কিছু গবেষণা প্রাথমিকভাবে সাক্ষ্য দিয়েছে যে, চকলেটের পলিফিনোলগুলি এলডিএল কোলেস্টেরলগুলোর জারণ প্রক্রিয়া প্রতিরোধ করতে পারে।
৫। একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে, আমাদের শরীরের ভর সূচকের বা বিএমআই-এর মান কম হবার সাথে চকলেট খাওয়া দারুনভাবে সম্পর্কিত।
৬। কয়েকটি মৌলিক গবেষণার মাধ্যমে চকলেটের অন্যান্য সম্ভাব্য ভাল প্রভাব সম্পর্কে জানা গেছে যে, চকলেট ক্যান্সার প্রতিরোধী, মস্তিষ্ক উদ্দীপক, কাশি নিরোধক এবং ডায়রিয়া বিরোধী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে।
৭। কোকোর দানাগুলিতে অনেকবেশি পরিমাণে ফ্ল্যাভোনয়েডস নামক একপ্রকারের রাসায়নিক উপাদান থাকে। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে, এই ফ্ল্যাভোনয়েডস গুলি ডায়রিয়ার উপসর্গ থেকে মুক্তি দেবার জন্য প্রস্তুতকৃত প্রাকৃতিক সম্পূরক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ডার্ক চকলেটে অতি উচ্চমাত্রায় কোকো থাকে এবং এটি ডায়রিয়া থেকে সামান্য মুক্তি দিতে সক্ষম।
৮। কঠিন কোকোতে কিছু অ্যালকোহল থাকে। যেমন থিয়োব্রোমিন, ফিনেথায়লামিন এবং ক্যাফিন। আমাদের দেহে এদের কিছু শারীরবৃত্তীয় প্রভাব আছে এবং এরা আমাদের ব্রেনের একটি উপাদান যার নাম সেরোটোনিন-এর মাত্রাকে বৃদ্ধির করে দিতে পারে। অর্থাৎ আমাদের দেহের স্নায়ুকোষের উপর কোকো সামান্য প্রভাব ফেলে। বিষাদগ্রস্ত ব্যক্তিদের দেহে সেরোটোনিন এর মাত্রা কমে যেতে পারে। সুতরাং আমাদের মনকে প্রফুল্ল রাখতে চকলেট সহায়তা করতে পারে।
– আমাদের স্বাস্থ্যের উপর চকলেটের মন্দ প্রভাবসমূহঃ
১। মনে করা হয় যে চকলেট আমাদের বুকজ্বালা-পোড়া করবার জন্য দায়ী। কারণ চকলেটে থিয়োব্রোমিন নামক একটি উপাদান থাকে। যা কিনা আমাদের খাদ্যনালীর পেশিকে শিথিল করে দেয়। অতঃপর পাকস্থলীর অম্নীয় উপাদানগুলি খাদ্যনালীতে প্রবেশের জন্য সুযোগ পায়। আবার থিয়োব্রোমিন অনেক প্রাণীর জন্যই বিষাক্ত। তার কারণ এরা প্রায়ই সময়ই প্রাণীর অন্ত্রে বিপাকে অক্ষম।
২। চকলেট আমাদের দেহকে মোটা করে দেবার জন্যে দায়ী। কাঁচা চকলেটে কোকো মাখন নামক চর্বি অনেক বেশি থাকে। চকলেট উৎপাদনকারীরা চকলেটের সাথে অন্যান্য উপাদান যেমন চর্বি, চিনি ও দুধ যোগ করে। আর এইসব উপাদান আমাদের দেহকে মোটা করে দেবার জন্যে দায়ী।
৩। চকলেট এবং কোকো সাধারণত সীমিত থেকে অধিক পরিমাণে অক্সালেট ধারণ করে থাকে। এই অক্সালেট জন্যে আমাদের কিডনিতে পাথর হবার একটি ঝুঁকি থাকে।
৪। উৎপাদনের সময় চকলেট পরিবেশ থেকে সীসা শোষণ করে এবং এর জন্য ধরে নেয়া হয় যে, কিছু ধরণের চকলেটে সামান্য সীসা দ্বারা বিষক্রিয়া ঘটেছে। যা স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর। তবে এর পরিমাণটা অতি সামান্য।
৫। বয়স্ক ব্যক্তিদের উপর চকলেটের প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা করে দেখা গেছে যে, চকলেট বয়স্ক ব্যক্তিদের অস্টিওপরোসিস নামক হাড়ের ক্ষয় রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
৬। কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, চকলেটের জন্যে বাচ্চাদের এলার্জির সমস্যা হতে পারে।
৭। বেশকিছু প্রমান পাওয়া গেছে যে চকলেট মানুষের জন্যে নিয়মিত খাওয়াটা নেশার মতো একটি আসক্তি সৃষ্টি করে।
– কোকো এবং চকলেটের পুষ্টি তথ্যঃ
স্বাস্থ্যের উপর কোকো এবং ডার্ক চকলেটের উপকার নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। কোকো এবং চকলেট প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট (ফ্লাভিনয়েডস্) ধারণ করে।
নিম্নে চকলেটে পুষ্টির পরিমাণটা দেখানো হয়েছে একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডকে বিবেচনা করে। এই মানের ভিন্ন মাত্রা বাইরে অন্যান্য চকলেটের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যেতে পারে। এখানে প্রতিটি মান নির্দিষ্ট উপাদানের শতকরা ওজন বিবেচনা করে নেয়া। প্রতিদিনের প্রয়োজনের শতকরা হারের উপর নয়।
উপাদান
কোকো –
লো ফ্যাট(ইউরোপিয়ান ধরণের) কোকো – হাই ফ্যাট(ব্রেকফাস্ট কোকো) মিষ্টি বাদে চকলেট তেঁতো স্বাদের চকলেট হাল্কা মিষ্টি চকলেট এবং বেকিং চকলেট
ফ্যাট ১০-১৫% ২০-২৫% ৪৫-৫৫% ৩৩-৪৫% ২০-৩৫%
কার্বোহাইড্রেট ৪৫-৬০% ৪৫-৬০% ৩০-৩৫% ২০-৫০% ৫০-৭০%
চিনি ০-২% ০-২% ০-২% ১৩-৪৫% ৪৫-৬৫%
খাদ্য আঁশ ২০-৩৫% ৩০-৩৫% ১৫-২০% ৫-৮% ৩-৮%
প্রোটিন ১৭-২২% ১৫-২০% ১০-১৫% ৫-১০% ৩-৮%
ক্যালরি প্রতি আউন্সে ৬০ ৯০ ১৪০-১৫০ ১৫০-১৬০ ১৩০-১৬০
ক্যালরি প্রতি ১০০ গ্রামে ২০০ ৩০০ ৪৭০-৫০০ ৫০০-৫৫০ ৪৫০-৫৫০
– কার্বোহাইড্রেট
এক চা-চামচ কোকো পাউডারে কার্বোহাইড্রেট থাকে প্রায় ৩ গ্রামের কিছু বেশি। তার প্রায় ২ গ্রামই হলো খাদ্য আঁশ। কোকো পাউডারে প্রায় চিনি নেই বললেই চলে। আর চিনির পরিমাণ এক চা-চামচ কোকো পাউডারে ০.১ গ্রামের থেকেও কম। আবার অন্য একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে, কোকো বীজের কার্বোহাইড্রেটের বেশির ভাগই স্টার্চ, দ্রবীভূত খাদ্য আঁশ এবং অদ্রবীভূত খাদ্য আঁশ।
– প্রোটিন
প্রতি চা-চামচ কোকো পাউডারে প্রোটিন থাকে প্রায় ১ গ্রাম।
– ফ্যাট
প্রতি চা-চামচ কোকো পাউডারে ফ্যাট থাকে প্রায় ০.৭৪ গ্রাম । যা মধ্যে প্রায় অর্ধেক গ্রাম হলো স্যাচুরেটেড ফ্যাট। আবার অন্য একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে, কোকো বীজের প্রায় ৫০% হলো ফ্যাট। এই ফ্যাটের দুটি অংশের মধ্যে একটি হলো স্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড (পালমিটিক ও স্টিঅ্যারিক এসিড) এবং অন্যটি হলো মনো-আনস্যাচুরেডেট এসিড (অলিইক এসিড)। কোকো বাটার এবং চকলেট রক্তের কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে না। কিন্তু যখন মিল্ক চকলেট বা নিম্ন মানের চকলেট খাওয়া হয়, তখন দুধের ফ্যাট অথবা অন্যান্য ধরণের যে সব ফ্যাট আসে তা আমাদের দেহের কোলেস্টেরলের মাত্রাকে প্রভাবিত করে।
– অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট
কোকো বীজে পলিফিনোলস্ আছে, যা কিনা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট গুণ সম্পন্ন এবং স্বাস্থ্যের জন্যে উপকারী। এই উপাদানগুলিকে বলা হয় ফ্লাভোনয়েডস্ এবং এরা ক্যাটচিন্স, এপিক্যাটচিন্স ও প্রোসাইআন্ডিন্স যুক্ত। এই অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ফ্লাভোনয়েডস্ গুলো কোকো বীজের ফ্যাট বাদে অংশে পাওয়া যায়। ফ্লাভোনয়েডস্ রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয় এবং এইভাবে স্টোক ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিকে কমিয়ে দেয়।
পলিফিনল অথবা ফ্লাভনয়েডগুলি হলো এই অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট আমাদের কোষের ফ্রি-রেডিকেলগুলির সক্রিয়তাকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে আমাদের দেহকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। ফ্রি-রেডিকেল হলো আমাদের দেহের ভেতরে উপস্থিত ভেঙ্গে যাওয়া অক্সিজেন অনু। পলিফিনলগুলি কোষকে ধ্বংস কারক ক্ষতিকর এই ফ্রি-রেডিকেলগুলোকে আমাদের দেহ থেকে সরিয়ে ফেলতে সাহায্য করে। ফ্রি-রেডিকেল মানবদেহে থাকলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। পাশাপাশি ফ্রি-রেডিকেলগুলো ক্ষতিকর এলডিএল কোলেস্টেরলের সহায়তায় হৃদপিণ্ডের রক্ত চলাচল নালীতে জমাট বাঁধে এবং রক্ত চলাচলে বাঁধা সৃষ্টি করে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
– থিয়োব্রোমিনঃ
থিয়োব্রোমিন একটি খুব মৃদু উদ্দীপক। আবার এটি একটি ডায়ইউরেটিক। অর্থাৎ এটি ইউরিন বা মূত্র উৎপাদনের হার বৃদ্ধি করে। থিয়োব্রোমিন কিছু প্রাণী যেমন কুকুর, বিড়াল, তোতাপাখি এবং ঘোড়ার জন্য বেশ বিষাক্ত।
– ক্যাফিনঃ
কোকো বীজে অতিঅল্প পরিমাণে ক্যাফিন থাকে। এই ক্যাফিনের মাত্রাটা চা, কফি বা কোলা জাতীয় পানীয়র তুলনায় কোকোতে অনেক কম। ক্যাফিন চকলেটে মূলত উদ্দীপক উপাদান হিসেবে কাজ করে থাকে। ক্যাফিন আমাদের দেহকে উত্তেজিত করে, ব্রেনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে ব্রেনকে করে তোলে সজাগ।
চকলেটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত কোকো বীজগুলোকে প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্যে তাপ দিয়ে শুকিয়ে গাঁজন করা হয়। এতে করে কোকো বীজগুলোতে চকলেট সদৃশ গন্ধ ও রং দেখা দেয়। কোকো বীজে ক্যাফিনের পরিমাণটা নির্ভর করে মূলত কোকো বীজের ধরণ এবং গাঁজন প্রক্রিয়ার মাত্রার উপর।
বিভিন্ন উৎস হতে প্রাপ্ত কোকো বীজকে বিশ্লেষণ করে নিম্নলিখিত ক্যাফিনের শতকরা হার পাওয়া যায়ঃ-
গড় (২২টি নমুনা) : ০.২১৪%
সর্বোচ্চ : ০.৪১৬%
সর্বনিম্ন : ০.০৬২%
মূলত কোকো বীজে ক্যাফিনের পরিমাণটা ০.১ থেকে ০.৫% সীমা পর্যন্ত হতে পারে। আফ্রিকান কোকো বীজ যা কিনা খুব ভালোভাবে গাঁজন করা হয়, তাতে ক্যাফিনের পরিমাণটা খুবই সামান্য এবং তা প্রায় ০.১% বা তারও কম।
কঠিন ৪০ গ্রাম মিল্ক চকলেটে ক্যাফিনের হার প্রায় ২-২৩ মিলিগ্রাম। আর ২২৭ গ্রাম ওজন যুক্ত একগ্লাস চকলেট দুধে ক্যাফিনের পরিমাণ প্রায় ২-৭ মিলিগ্রাম। একটি ২৮ গ্রাম ওজনের ডার্ক চকলেট যা কিনা তেঁতো স্বাদযুক্ত কালো চকলেট, তাতে ক্যাফিনের পরিমাণটা প্রায় ৫-৩৫ মিলিগ্রাম।
অন্যদিকে কফিতে ক্যাফিনের পরিমাণটা অনেক বেশি। ২২৭ গ্রাম ওজনযুক্ত এককাপ কফিতে ক্যাফিনের পরিমাণ প্রায় ৭৫ মিলিগ্রাম। আর ঐ একই পরিমাণের ব্রু-কফি বা ঘনীভূত কফিতে ক্যাফিনের পরিমাণ প্রায় ১৪০ মিলিগ্রাম।
বিজ্ঞানী কিআফার এবং মার্টিন-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, কোকো বাটারে ক্যাফিন এবং থিয়োব্রোমিন এর পরিমাণ অনেক অনেক কম এবং তা প্রায় ০.০৩৮% এবং ০.০০৮% হারে থাকে।
– ফিনাইলইথাইলঅ্যামিনঃ
ফিনাইলইথাইলঅ্যামিন একটি মৃদু অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট বা বিষাদগ্রস্ত দূরকারী উপাদান। অর্থাৎ এটি মনকে প্রফুল্ল রাখে। এটি একটি উদ্দীপকও বটে। দেহে উপস্থিত ডোপামিন এবং অ্যাড্রেনালিন এর মতোন এটি কাজ করে থাকে।
– চকলেটে কোন কোন মিনারেল বা খনিজ লবণ থাকে ?
চকলেটে অনেক প্রয়োজনীয় মিনারেন বা খনিজ লবণ থাকে। চকলেটের কোকো অংশে থাকে ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, কপার, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, পটাশিয়াম এবং জিংক থাকে। এই সমস্ত মিনারেন আমাদের ব্রেনের কার্যক্রম, দেহের কোষের বৃদ্ধি, টিস্যুর সঠিক গঠনবিন্যাস এবং দেহে পুষ্টি উপাদানের শোষণে অনেক সহায়তা করে। এছাড়া কোকোতে সেলেনিয়াম থাকে। সেলেনিয়াম একটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। চকলেটে যুক্ত দুধের অংশ থেকে আমরা প্রায় অন্যান্য সমস্ত মিনারেনসহ বাড়তিভাবে সোডিয়াম পেয়ে থাকি।
– চকলেটে কোন কোন ভিটামিন থাকে ?
আমরা বাজার থেকে সাধারণত যে সমস্ত চকলেট কিনি তার মূল উপাদান কোকো এবং দুধ, তাই চকলেটে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন উপস্থিত থাকে। চকলেটের মূল কোকো অংশে ভিটামিন-ই, ভিটামিন-কে সহ ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স বিদ্যমান থাকে। বি-কমপ্লেক্স ভিটামিনের মধ্যে মূলত বি-১, বি-২, বি-৩, বি-৫, বি-১১ এবং কোলিন থাকে। চকলেটে দুধ থেকে প্রাপ্ত ভিটামিন মূলত ভিটামিন-এ, ভিটামিন বি-১২ এবং ভিটামিন-ডি থাকে। ভিটামিন-সি চকলেটে থাকে না। কোকোতে উপস্থিত ভিটামিন বি-১ এবং ভিটামিন বি-৫ অধিক তাপে নষ্ট হয়ে যায়। তবে চকলেট গরমে গলে গেলে এতে উপস্থিত কোনো ভিটামিনই নষ্ট হয় না। ফল বা বাদাম যুক্ত চকলেট থেকে আমরা অতিরিক্ত ভাবে ফল বা বাদামে উপস্থিত ভিটামিন পেয়ে থাকি। উক্ত ভিটামিনগুলি চকলেটে উপস্থিত থাকলেও এর সামান্য পরিমাণের জন্যে তা একজন মানুষের প্রতিদিনের ভিটামিন চাহিদা খুব সামান্য পূরণ করে থাকে।
– চকলেটে ক্যালরিঃ
কোকো পাউডার একটি নিম্ন ক্যালরিযুক্ত খাদ্য এবং অতি অল্প পরিমাণে আমরা এটি খাই। তাই এটি আমাদের প্রতিদিনের ক্যালরি চাহিদার উপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। এক চা-চামচ কোকো পাউডারে ১২ ক্যালরি থাকে। যেখানে প্রতিদিন সাধারণত ২০০০ ক্যালরি প্রয়োজন সেখানে এই চকলেটের পরিমাণটি আমাদের চাহিদার ১% এরও কম। যদি চকলেটে এর তেঁতো স্বাদ দূর করার জন্য চিনি যোগ করা হয়, তবে এর ক্যালরির পরিমাণটা হাল্কা বৃদ্ধি পায়। প্রতি চা-চামচ চিনিতে প্রায় ১৬ ক্যালরি বিদ্যমান থাকে।
– চকলেট কি মোটা হয়ে যাবার জন্য দায়ী ?
হ্যাঁ, চকলেট আপনাকে মোটা করে দেবার জন্য দায়ী। প্রতিটি ডার্ক চকলেটে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাট এবং চিনি থাকার জন্যে এতে ক্যালরির পরিমাণ অনেক। চকলেটে ফ্যাটের উপস্থিতি থেকে চিনির উপস্থিতি স্বাস্থ্যের জন্যে বেশি ক্ষতিকর।
– ডার্ক চকলেটঃ
কোকো বীজ থেকে উৎপন্ন একটি পরিশোধিত দ্রব্য হলো এই ডার্ক চকলেট। ডার্ক চকলেটের সমস্ত স্বাস্থ্য গুণাগুণ পেতে হলে কমপক্ষে ৭০-৮০% কোকো থাকতে হবে এই চকলেটে।
– ডার্ক চকলেটের স্বাস্থ্যের প্রতি ভালো গুণাগুণঃ
ইটালিয়ান একটি গবেষণার উপর ভিত্তি করে জানা গেছে যে, একটি ছোট চারকোণা ২০ গ্রাম ওজনের তেঁতো স্বাদযুক্ত ডার্ক চকলেট প্রতি ৩ দিন পরপর গ্রহণ করলে এটি আমাদের হৃদপিণ্ডের জন্য অনেক উপকার বয়ে নিয়ে আসে। তবে বেশি পরিমাণে চকলেট খেলে তা মোটেও আমাদের শরীরের জন্যে সুফল বয়ে নিয়ে আসে না।
১। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
২। ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
৩। কোলন বা অন্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
৪। হার্টের অসুখ হওয়া থেকে বাঁচায়।
৫। রক্তে শর্করার পরিমাণ এবং ইনসুলিনের নির্ভরশীলতা ঠিক রাখে।
৬। এইডস এর অগ্রগতিকে মন্থর করে দেয়।
৭। বয়স বৃদ্ধির ফলে চামড়াতে ভাঁজ পড়ার হার মন্থর করে।
৮। দেহে ডিএনএ-কে মেরামত করে এবং রক্ষা করে।
৯। হৃদরোগ উপশম করে।
১০। উচ্চ রক্তচাপ উপশম করে।
১১। চোখের গঠন উন্নত করে।
১২। যে কোনো কিছু ভুলে যাওয়া রোগ বা অ্যালঝিমার্স থেকে বাঁচায়।
১৩। অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ের ক্ষয় হয়ে যাওয়া রোগ থেকে বাঁচায়।
১৪। স্ট্রোক থেকে বাঁচায়।
১৫। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়।
১৬। মাইগ্রেনের জন্যে মাথা ব্যথার হার কমায়।
১৭। রজঃস্রাব পূর্ব লক্ষণ থেকে উপশম করে।
১৮। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট প্রটেকশন করে।
১৯। মৃগীরোগের আক্রমন প্রতিরোধ করে।
২০। ঠান্ডা লাগা উপশম করে।
২১। মাথায় টাক পড়া রোগ বা অ্যালোপেসিয়া প্রতিরোধ করে।
– পৃথিবীর ১০টি সবচেয়ে জনপ্রিয় চকলেট ব্রান্ডের নামঃ-
আপনার পছন্দের চকলেটটিতে একটি কামড় দেবার সময় বা যখন তৃপ্তিসহকারে এটি চিবাচ্ছেন তখন, কখনও কি একটু কল্পনা করেছেন যে এটি কিভাবে আপনার হাতে পৌঁছালো ? এটি একটি ক্রীম, দুধ আর কোকোর দারুন মিশ্রণ যা কিনা আপনার কাছে এর একটি ভালোবাসার স্বাদ রেখে যাবে।
চকলেট আপনাকে নিঃস্বন্দেহে সন্তুষ্ট করে আপনার মনকে করে তুলে প্রফুল্ল। অবশ্য পুষ্টির দিক থেকে বিবেচনা করে বলা যায় যে, চকলেটের অনেক অনেক ভালো দিক রয়েছে রক্তচাপ রোগীর জন্যে, ডায়াবেটিস কমিয়ে আনতে এবং শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে।
গোটা পৃথিবী জুড়ে মানুষেরা বিভিন্ন মিশ্রণের নানান ব্র্যান্ডের সহজে প্রাপ্য চকলেটের স্বাদ উপভোগ করে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ১০টি চকলেট ব্রান্ড হলো –
১০। কিট ক্যাট
৯। মার্স
৮। গ্যালাক্সি
৭। ক্যাডবেরী
৬। টোব্লেরোন
৫। প্যাট্চি
৪। গাইলিয়ন
৩। ঘিরারদেল্লি
২। লিন্দত ও শপ্রুংলি
১। ফেররেরও রোচার
– চকলেট খাওয়া যাদের জন্য ক্ষতিকরঃ-
১। চকলেটে উপস্থিত চিনি মোটা ব্যক্তিদের দেহের ওজন আরও বাড়িয়ে দেয়। তাই মোটা ব্যক্তিদের জন্যে চকলেট খাওয়া মোটেও ঠিক নয়।
২। দেহের কোনো স্থানে কেটে গেলে যাদের সহজে রক্ত জমাট বাঁধে না, তাদের ক্ষেত্রে চকলেট খাওয়া ক্ষতিকর। কারণ, চকলেটের কিছু উপাদান দেহের ক্ষতস্থানের রক্ত জমাট বাঁধতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।
৩। যাদের দাঁতে ক্ষত আছে কিংবা যাদের রাতে শোবার পূর্বে দাঁত মাজার অভ্যাস নেই, তাদের জন্যে চকলেট খাওয়াটা ক্ষতিকর। কারণ, চকলেটে উপস্থিত দুধ ও চিনি দাঁতে ক্ষয় করবার জন্যে দায়ী।
৪। চকলেটে নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির জন্যে চকলেট খাওয়া ক্ষতিকর।
৫। ভালো মতো ঘুম হয় না, এরূপ ব্যক্তির জন্যে চকলেট খাওয়াটা ক্ষতিকর।
৬। যাদের পেটে হজমের সমস্যা আছে, তাদের জন্য চকলেট খাওয়া ক্ষতিকর।