নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলায় অপরুপ প্রাচীন নিদর্শন বড় সর্দার বাড়ি। সোনারগাঁয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। সর্দার বাড়ির অন্যতম এক বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে সূক্ষ্ম টেরাকোটা ও অসাধারণ কারুকার্য। যা বাড়িটির বাইরে থেকে স্পষ্ট উপলব্ধি করা যায়।
বাড়ির সামনে ও পেছনে উভয় পাশেই রয়েছে চমৎকার দুটি দীঘি। সামনের দীঘিটিতে চোখে পড়বে তলোয়ার হাতে ঘোড়ার পিঠে দুই সৈনিকের মূর্তি। আর সর্দার বাড়ির পেছনের দীঘিতে দেখতে পাবেন শান বাঁধানো ঘাট। যে কেউ চাইলে এই ঘাটে বসে উপভোগ করতে পারেন চমৎকার মুহূর্ত।
সর্দার বাড়িটির মোট আয়তন ২৭ হাজার ৪০০ বর্গফুট। বাড়ির দোতলাবিশিষ্ট ভবনের নিচ তলাতে রয়েছে ৪৭টি কক্ষ, দোতলায় রয়েছে ৩৭টি কক্ষ। এই কক্ষ গুলোতে রাখা হয়েছে প্রাচীন বাংলার হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিচিহ্ন, রাখা হয়েছে প্রাচীন গ্রাম বাংলার মানুষের তথা কৃষক, কামার, কুমার, তাঁতি ও জেলে থেকে শুরু করে প্রায় সকল শ্রেণী পেশার মানুষের নিত্যদিনের ব্যবহার্য নানান সব আসবাপত্র ও ব্যবহার্য পণ্য-সামগ্রী, বর্তমান সময়ে গ্রামীণ সংস্কৃতির অধ্যায় থেকে যা প্রায় বিলুপ্তির পথে।
বড় সর্দার বাড়িটি কয়েক বছর আগেও বিলুপ্তির পথে ছিল। বহু সময় ধরে কোনো সংস্কার না করার কারণেই বাড়িটি ধ্বংসপ্রায় অবস্থায় পৌঁছেছিল। ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল ভবনটির ছাদসহ বিভিন্ন অংশ। সেসময় 'ইয়াংওয়ান কর্পোরেশন' নামে কোরিয়াভিত্তিক একটি কোম্পানি বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের কাজে আগ্রহ প্রকাশ করে। ২০১২ সালে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাথে বাড়িটির আদিরূপ ফিরিয়ে আনার চুক্তি করে তারা।
বাড়িটির সংস্কার প্রসঙ্গে মতামত বিনিময়ের সময় ইয়াংওয়ান কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান এক সাক্ষাৎকারে বলেন , 'সর্দার বাড়ির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য আমাদেরকে সত্যিই খুব মুগ্ধ করেছে। এ কারণেই আমরা ইতিহাসের সাক্ষী হতে সংস্কার কাজে অনুদান দিয়ে বাড়ির আদিরূপ ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি।'
এই বাড়িটির সংস্করণ কাজে সর্বমোট ২০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। সম্পূর্ণ খরচ বহন করেছে ইয়াংওয়ান কর্পোরেশন। এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান স্যার আবু সাইদ এম আহম্মেদ এই বাড়িটির আদি রূপ ফিরিয়ে আনতে স্থপতি হিসেবে অবদান রাখেন। বাড়িটির সংস্কার কাজে মেঝেতে ব্যবহার করা হয়েছে টাইলস এবং মার্বেল পাথর। এছাড়াও চীনা মাটির প্লেট, চিটাগুড় ও তেঁতুলের বীচির প্রলেপ ব্যবহার করা হয়েছে বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণে।
বাড়িটির মেরামত করার জন্য ১৫০ জন সুদক্ষ রাজমিস্ত্রীকে আনা হয়েছিল নওগাঁ ও পাহাড়পুর থেকে। তাদেরই সুদক্ষ হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় বাড়িটি যেন ফিরে পেয়েছে পুরনো সেই রুপ।
সর্দার বাড়ির পাশেই রয়েছে লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর। গ্রাম বাংলার লোক ও কারুশিল্পের হারানো সব প্রাচীন নিদর্শন স্থান পেয়েছে সেই জাদুঘরটিতে। সর্দার বাড়ির সংস্কার কাজের চুক্তি ২০১২ সালে সংগৃহীত হলেও এই বাড়িটিকে লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরের অন্তর্ভুক্ত করা হয় ১৯৮১ সালে। আজ থেকে প্রায় ৬০০ শত বছর আগে নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল বাড়িটির। অনেকের কাছেই দোতলাবিশিষ্ট এই ভবনটি গোপীনাথ সাহা সরদার বাড়ি নামেও পরিচিত।
প্রায় ৬০০ বছর আগে ঐশ্বর্যকান্ত সাহা সরদার নামে তৎকালীন এক ধনী ব্যবসায়ী এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। যদিও পরবর্তীতে বারো ভূঁইয়াদের প্রধান ও পর্যায়ক্রমে সম্রাট ঈশাখাঁ এই বাড়িটির দখলদারিত্ব লাভ করেন। সুলতানি আমলের পথ ধরে মোঘল আর সর্বশেষ ব্রিটিশ রাজত্বের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক এই বাড়িটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে বাংলার তৎকালীন রাজধানী সোনারগাঁয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
যেভাবে যাবেন :
ঐতিহাসিক এই নিদর্শনটির ঢাকা থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। ঢাকা থেকে খুব সহজেই যাওয়া যায় সেখানে। এমনকি দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসা যায়। সর্দার বাড়ি দেখতে হলে আপনাকে প্রথমেই যেতে হবে গুলিস্থান। সর্দার বাড়ি যেতে হলে গুলিস্থান থেকে আপনার পরবর্তী গন্তব্য হবে মোগরাপাড়া চৌরাস্তা। গুলিস্থান থেকে বেশ কিছু বাস মোগরাপাড়া চৌরাস্তার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। যেমনঃ স্বদেশ , দোয়েল ও বোরাকের এসি বাসগুলো। এক্ষেত্রে স্বদেশ , দোয়েল ও বোরাকের এসি বাসে গুলিস্থান থেকে মোগরাপাড়া চৌরাস্তা পর্যন্ত ভাড়া পড়বে যথাক্রমে ৪০, ৪৫ এবং ৫০ টাকা। তারপর মোগরাপাড়া চৌরাস্তা নেমে যেকোনো ব্যাটারি চালিত অটো কিংবা রিক্সাকে বললেই আপনাকে নিয়ে যাবে ঐতিহাসিক সর্দার বাড়িতে।
সময়সূচী ও প্রবেশ মূল্য:
শীত মৌসুমে ১লা অক্টোবর থেকে ৩০-শে মার্চ পর্যন্ত সকাল ৯টা হতে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। আর গ্রীষ্মকালে পর্যটকদের জন্য ১লা এপ্রিল থেকে ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সকাল ১০টা হতে বিকেল ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ১০০ টাকা। আর বিদেশি নাগরিকদের জন্য জনপ্রতি ২০০ টাকা করে। সপ্তাহে দুই দিন অর্থাৎ বুধবার ও বৃহস্পতিবার পর্যটকদের জন্য এটি বন্ধ থাকে।