আর্সেনিক বিষক্রিয়ার ফলে শরীরে বিরুপ জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটছে। এতে শরীরের প্রাণ রাসায়নিক পদার্থের হচ্ছে পরিবর্তন। কোনোটির পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে অথবা কমিয়েও দিচ্ছে। আর্সেনিকের কারণে পদার্থগুলোর স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কম বেশি হওয়ায় ক্যান্সার, হৃদরোগ থেকে শুরু করে লিভার সমস্যা, কিডনিরোগ, চর্মরোগসহ নানারকম দীর্ঘমেয়াদী রোগের ঝুঁকি মারাত্মক ভাবে বাড়ছে। বাড়াচ্ছে মৃত্যু ঝুঁকিও। দেশের ৫ টি জেলার আর্সেনিক কবলিতদের উপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১০ টি গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণা বলছে, আর্সেনিক কবলিত এলাকার শুধু পানি নয়, শাক-সবজি খাদ্যজাত দ্রব্যের সাথে আর্সেনিক মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। যা বিশেষ করে শরীরের রক্তানালিকা গুলো ক্ষতিগ্রস্থ করছে। এছাড়া শরীরের আবরণী কলাগুলো ক্ষতিগ্রস্থের মাধ্যমে এর ভিতরে অবস্থিত এনজাইম বা জৈব রাসায়নিক পদার্থ যেগুলো শরীরকে সুস্থ রাখতে নিয়মিত ভূমিকা পালন করে সেগুলোর স্বাভাবিক মাত্রার কম বেশি করছে। যার ফলে নানা রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শরীরে থাকা প্রাণ রাসায়নিক পদার্থগুলো বিশ্লেষনের মাধ্যমে আর্সেনিকের কারণে রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে এমন ২০ টি এনজাইম বা শরীরের জৈব রাসায়নিক পদার্থের তথ্য উঠে এসেছে এই গবেষণায়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, এই এনজাইম বা জৈব রাসায়নিক পদার্থগুলোর পরিবর্তনে আর্সেনিকের ভূমিকার রয়েছে। গবেষণার এই সব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক জার্নালে।
গবেষণায় উঠে আসা এমন কিছু জৈব রাসায়নিক পদার্থ হলো- অক্সিডাইজ লো ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন (ওএক্সএলডিএল), ল্যাকটেট ডিহাইড্রোজেনেজ (এলডিএইচ), সি রিএ্যাকটিভ প্রোটিন (সিআরপি), ভাসকুলার সেল এডহেসন মলিকিউল (ভিক্যাম), ইন্টার সেলুলার এডহেসন মলিকিউল (আইক্যাম), প্লাজমা ইউরিক এসিড, ম্যাট্রিক্স মেটালোপ্রোটিনেজ-৯ (এমএমপি-৯), এ্যাসপারটেট ট্রান্সামাইনেজ (এএসটি), ম্যাট্রিক্স মেটালোপ্রোটিনেজ-(এমএমপি-২), অ্যালানিন আমাইনো ট্রান্সফারেজ (এএলটি), বিগ এনডোথেলিয়াল (বিগ-ইটি-১), ভাসকুলার এনডোথেলিয়াল গ্রোথ ফ্যাক্টর (ভিইজিএফ), অ্যালকালাইন ফসফাটেজ(এএলপি) থ্রোম্বো মডিউলিন।
আর্সেনিক এই ১৪ টি জৈব রাসায়নিক পদার্থের পরিমাণ শরীরের মধ্যে বাড়িয়ে দিয়ে ক্যান্সার, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, চর্মরোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এছাড়াও শরীরের মধ্যে ভিইজিএফ, আইক্যাম, ভিক্যাম, এমএমপি-২, এমএমপি-৯ ও এর পরিমাণ বাড়ায় ক্যান্সার ঝুঁকি বাড়ছে।
গবেষণা বলছেন, আর্সেনিক ক্যান্সার সৃষ্টি করে এটা প্রতিষ্ঠিত। তবে হৃদরোগ সৃষ্টিতে আর্সেনিক শক্তিশালী ভূমিকা রাখে সে বিষয়টি প্রথম প্রমাণিত হয়েছে। সাধারণত হৃদরোগ আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে এইচডিএল এর পরিমাণ স্বাভাবিক থাকে কিন্তু এলডিএল ও টিসি এর পরিমাণ বেশি থাকে। তবে আর্সেনিক বিষক্রিয়া মানুষের ক্ষেত্রে এই পদার্থগুলোকে স্বাভাবিক করে দেয়। যা হৃদরোগের ঝুকি কমায়। কিন্তু মজার বিষয় হলো নতুন আরেকটি প্রাণ রাসায়নিক পদার্থ শরীরের মধ্যে বাড়িয়ে দিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় আর্সেনিক। যা চিকিৎসকদের প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষায় ধরা পড়ে না।
তারা দাবি করছেন, হৃদরোগের ঝুকি বাড়াতে ক্যান্সার তৈরিতে ভূমিকা রাখা ঐ ৫ টি (বায়ো মলিকুল) জৈব রাসায়নিক পদার্থসহ ওএক্সএলডিএল, সিআরপি, ইউরিক এসিডের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
অন্যদিকে বিগ-ইটি-১, থ্রোম্বো মলিকুল পদার্থ দুইটির পরিমাণ শরীরে বাড়িয়ে দিয়ে উচ্চ রক্তচাপ ও চর্ম রোগের প্রবণতা বাড়ছে। হাই ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন (এইচডিএল) এর পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে ক্যান্সার তৈরিতে সাহায্য করছে আর্সেনিক। পিএইচসিই এর পরিমাণ কমে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ব্রেইন। তাছাড়া ল্যাকটেট ডিহাইড্রোজেনেজ (এলডিএইচ) বাড়িয়ে দিয়ে আর্সেনিক শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো ক্ষতিগ্রস্থ করছে। গবেষণা বলছে, পরিসংখ্যানগতদিক দিয়ে আর্সেনিকের মাধ্যমে পদার্থগুলোর এই কম বেশি হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষকদের দাবি, আর্সেনিকের কারণে ঐসব দীর্ঘমেয়াদি রোগ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে যে পদার্থগুলো সেগুলো থেকে চিকিৎসকদের নাগালের বাইরে। সাধারণ পরীক্ষায় রোগগুলো ধরা পড়লেও কি কারণে রোগ সৃষ্টি হচ্ছে তা জানতে পারছেন না চিকিৎসকরা। তাই ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আর্সেনিক আক্রান্ত ও আক্রান্ত নয় এমন প্রায় সাড়ে সাতশ লোকের উপর করা হয়েছে এই গবেষণা। টিউবওয়লের পানি, শাক সবজি, চাউল এবং শরীরের চুল, নখ ও বুকের দুধ, রক্ত ও প্রসাবকে স্যাম্পল হিসাবে ব্যাবহার করেছেন গবেষকরা।
প্রথমে আর্সেনিক আক্রান্ত লোকদের খাবার পানি, নখ চুল পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে। যেগুলোর পরীক্ষা শেষে জানতে পেরেছেন শরীরে আর্সেনিক কি পরিমাণ আছে। পরবর্তীতে আক্রান্তদের শরীর হতে সংগ্রহ করা হয়েছে ব্লাড ও প্রসাব। শরীরের এই দুটি বিষয় পরীক্ষা নীরিক্ষার পর আর্সেনিক শরীরে ঐসব রোগ তৈরিতে কিভাবে ভূমিকা রাখছে সে বিষয়ক তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষকরা জানান, সঠিক তথ্য নিরুপণ করতে দেশীয় ও বিদেশী গবেষণাগারে নমুনাগুলোকে পরীক্ষা করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে জাপান ইংল্যান্ড, সুইডেন, আমেরিকাসহ মোট চারটি দেশের গবেষকদের সাথে সমন্বয় করে তাদের গবেষণাগারে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হয় এসব নমুনা। ২০০৭ সালের শেষের দিকে গবেষণা শুরু করেন গবেষকরা।
গবেষকরা আরও জানান, এদিকে শুধু পানি নয় আর্সেনিক কবলিত এলাকায় উৎপাদিত অনেক খাদ্যজাত দ্রব্য প্রাণ বিনাশি এসব রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে মারাত্মক ভাবে। তাছাড়া জানাচ্ছেন বর্তমানে দেশে হৃদরোগে মানুষের মৃত্যুর বড় একটি কারণ হয়ে দাড়িয়েছে আর্সেনিক কবলিত এলাকার শাক সবজি।
গবেষকদল প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আর্সেনিক গবেষক অধ্যাপক খালেদ হোসেন। অধ্যাপক খালেদ জানান, ক্যান্সারের ঝুঁকি তিন গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে আর্সেনিক কবলিত এলাকার চাউল। তাছাড়া আর্সেনিক কবলিত এলাকাতে যে শাক সবজি জন্মে তা সবই আর্সেনিক হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে সবুজ শাক সবজিও ভিন্নতর নয়।
এদিকে দেশের আরও কয়েকটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ সৃষ্টিতে আর্সেনিক ভূমিকা রয়েছে বলে চিন্থিত করতে পেরেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্সেনিক গবেষকদল।বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের পরিবেশ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান গবেষণাগারে চলছে এই গবেষণা।