ভোরবেলা আপনি শুনতে পেলেন, আপনার শিশু দুর্বল কণ্ঠে বলছে, ‘মা, আমার পেটব্যথা করছে।’ সঙ্গে সঙ্গে মাথায় যে চিন্তা আসে তা হলো, সত্যিই কি তার পেটব্যথা করছে? এটি হোমওয়ার্ক না করার কিংবা স্কুলে না যাওয়ার বাহানা নয়তো?
আপনার শিশুর বয়স ১২ বছরের কম হলে প্রায় নিশ্চিতভাবে উত্তরটি—হ্যাঁ, আপনার শিশুর পেটব্যথা করছে। সাধারণত ১২ বছরের নিচের শিশুদের অসুস্থতার ভান করার ক্ষমতা থাকে না। যদি আপনার শিশু পেটব্যথার কথা বলে, আপনি ধরে নিতে পারেন যে সত্যিই তার পেটব্যথা করছে।
অনেক সময় শিশুদের পেটব্যথার কারণ হলো বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য কিংবা স্নায়ুদুর্বলতা। যদি উপসর্গগুলো তীব্র হয়, আপনি দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাবেন। যদি হাতের নাগালে চিকিৎসক না পান তাহলে নিচের কিছু ঘরোয়া চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেন। এগুলো চিকিৎসক কর্তৃক অনুমোদিত।
গরম প্রয়োগ করুন
বেশিরভাগ শিশু তাদের পেটব্যথার সময় আরাম পাওয়ার জন্য তাপ খোঁজে। যদি আপনি আপনার হাঁটুর ওপর গরম পানির বোতল রাখেন এবং এরপর সেই বোতলের ওপর শিশুকে উপুড় করে শুইয়ে রাখেন, তাহলে আপনার শিশু আরাম পেতে পারে। বয়স্ক শিশুরা গরম প্যাড ব্যবহার করতে পারে, তবে এর তাপ যেন কম হয়। শিশুকে গরম প্যাডের ওপর উপুড় করে শুতে দেবেন না, বরং শিশুকে চিত করে শুইয়ে তার পেটের ওপর প্যাড রাখবেন।
পাকস্থলীর কাজের বোঝা কমান
অন্ত্রকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য এটি একটি চমৎকার পন্থা। ২৪ ঘণ্টা আপনার শিশুকে খাবার থেকে দূরে রাখুন। শিশুকে পরিষ্কার তরল, যেমন—ঝাঁজহীন সোডা, পানি ও মুরগির মাংসের ঝোল দিন। তাকে কোনো শক্ত খাবার দেবেন না।
ব্যথা কমাতে ওষুধ দিন
অ্যাসিটামিনোফেন বা প্যারাসিটামল আপনার শিশুর ব্যথা কমিয়ে দেয়। সিরাপের মোড়কের গায়ে লেখা নির্দেশনা দেখে শিশুর বয়স ও ওজন অনুযায়ী সঠিক মাত্রা প্রদান করুন। যদি আপনার শিশুর বয়স দুই বছরের কম হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
শিশুকে কখনো কোডিন দেবেন না
শিশুর পেটব্যথা করলে তাকে কখনো কোডিনভিত্তিক ওষুধ দেবেন না। এটা সাময়িকভাবে তার ব্যথা কমাতে পারে, কিন্তু এটা বেশ কিছু মারাত্মক অবস্থাকে আড়াল করে রাখে, অর্থাৎ এটার কারণে কিছু মারাত্মক সমস্যা বোঝা যায় না, যেমন—অ্যাপেন্ডিসাইটিস অথবা কোনো অবরুদ্ধ অবস্থা অথবা ইনফেকশন বা সংক্রমণ।
মলত্যাগের জন্য সময় দিন
আমাদের জীবনযাত্রার গতি বেড়ে যাওয়ায় আমরা শিশুদের সময় দিতে পারি না ঠিকমতো টয়লেট করার। সত্যিকার অর্থে শিশুদের আমরা বাড়িতে এবং স্কুলে খুবই ব্যস্ত রাখি। এতে তাদের গুরুতর কোষ্ঠকাঠিন্য ঘটে থাকে।
অনেক শিশু স্কুলে অনেকক্ষণ অবস্থান করে, তার পায়খানার বেগ এলেও চেপে রাখে। এতে মল দৃঢ়ভাবে এঁটে থাকে। এসব শিশুর খাওয়ার পরে ঘন ঘন পেটব্যথা হয়।
এসব সমস্যা ও ব্যথা প্রতিরোধের উপায় হলো শিশুকে প্রতিদিন সকালে টয়লেটে বাধাহীনভাবে ৫ থেকে ১০ মিনিট সময় দিতে হবে। বেশিরভাগ বাড়িতে সকালে টয়লেটে ভিড় জমে। কিন্তু শিশুর জন্য এটিকে দৈনন্দিন কাজের নিয়মিত অংশ হিসেবে গড়ে তুলুন, দাঁত ব্রাশ করার মতো। শিশু যেন প্রতিদিন সকালে টয়লেটে গিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে মলত্যাগ করতে পারে। তবে তাকে মলত্যাগের জন্য জোড়াজুড়ি করবেন না। তাকে সুযোগ দেবেন এবং ব্যাপারটা প্রাকৃতিকভাবে হতে দিন।
শিশুর মানসিক চাপ কমান
যদি আপনার শিশুর বমি না হয় অথবা কোষ্ঠকাঠিন্য না থাকে, তাহলে পেটব্যথা চাপের কারণ হতে পারে। চাপের কারণে বড়দের ব্যথা হয় মাথায়, আর শিশুদের বেলায় হয় পেটে। পরিবারে ঝগড়াঝাঁটি কিংবা পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতির কারণে শিশুর মধ্যে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। কীভাবে আপনি সাহায্য করতে পারেন? শিশুর পেটব্যথা মানসিক চাপ সম্পর্কিত হলে তার ভালোবাসা ও আদরের প্রয়োজন হয়। শিশুকে জড়িয়ে ধরুন, কোলে নিয়ে আদর করুন।
স্কুলভীতি দূর করুন
অনেক শিশুর মধ্যে এক ধরনের স্কুল-আতঙ্ক থাকে। এতে প্রায়ই তার পেটব্যথা করে। বিশেষ করে স্কুলে যাওয়ার আগে তার পেটব্যথা শুরু হয়। বকাঝকা না করে তার মন থেকে স্কুল নিয়ে আতঙ্ক দূর করুন। শিশুকে বোঝান যে স্কুল একটা মজার জায়গা, সেখানে অনেক নতুন বন্ধু হবে। স্কুলের শিক্ষককে বলুন, তিনি যেন আপনার শিশুর ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি না করেন। শিশুর ‘স্কুল-আতঙ্কজনিত পেটব্যথা’র কথা শিক্ষককে অবহিত করুন। শিক্ষক তার আচরণের মধ্য দিয়ে আপনার শিশুর মন থেকে স্কুল-ভীতি দূর করবেন।
স্পর্শথেরাপি দিন
যদি শিশুর সামান্য পেটব্যথা হয়, তাহলে সেটা উপশমের জন্য ম্যাসাজ হলো সবচেয়ে ভালো উপায়, বিশেষ করে সেই পেটব্যথা যদি অতিরিক্ত গ্যাস বা কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য হয়। এমনকি আপনার শিশু যদি খুব ছোটও হয়, তার পেটে ম্যাসাজ করলে সে ভালো বোধ করবে। আপনি ঘড়ির কাঁটার ঘূর্ণন দিক অনুযায়ী হালকা ম্যাসাজ করবেন, কিন্তু যদি আপনি উল্টোভাবে ডান দিকে ম্যাসাজ করেন, তাহলে শিশুর ব্যথা তো কমবেই না, বরং বেশি বেড়ে যাবে। এখানে কিছু উপায় দেওয়া হলো, যা ব্যথা উপশমে সাহায্য করবে।
শিশুকে চিত করে শুইয়ে দিন। আপনার দুই হাতের তালুতে সামান্য ভেজিটেবল ওয়েল বা ম্যাসাজ অয়েল নিয়ে ঘষে গরম করুন। আপনার তেলমাখা হাত শিশুর পেটে রেখে বৃত্তাকারে ঘড়ির কাঁটার ঘূর্ণন দিক অনুযায়ী ম্যাসাজ করুন। ম্যাসাজ শুরু করবেন পাঁজরের খাঁচার ঠিক নিচে, কুঁচকির পরিধি থেকে এবং পেটের দিকে অগ্রসর হবেন। কয়েক মিনিট পেট ঘুরে চলবেন, এরপর আপনার হাত বোলানো পরিবর্তন করুন।
শিশুকে চিত করে শুইয়ে রেখে, পাঁজরের ঠিক নিচে আনুভূমিকভাবে এক হাত রাখুন এবং সোজা কুঁচকির দিকে যান। অপর হাতটা ছন্দোময়ভাবে পেটে বোলান। কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করুন। এরপর আবার হালকা করে বৃত্তাকারে পেটে ম্যাসাজ করুন।
আপনার শিশু যদি এক ঘণ্টার মধ্যে কিছু না খায়, তাহলে আপনি তার পা দুটো ওপরে তুলে ধরে ম্যাসাজ করার চেষ্টা করতে পারেন। এক হাতে তার পা দুটো ধরে প্রায় ৯০ ডিগ্রি কোণে ওপরে তুলে অন্য হাত দিয়ে পেটে ম্যাসাজ চালিয়ে যান। আপনার শিশু ছোট হলে পা দুটো তোলা সহজ হবে। কিন্তু যদি আপনার শিশু বয়স্ক হয়, তাহলে তাকে শুয়ে থেকে হাঁটু দুটো ভাঁজ করতে বলতে পারেন, যাতে পায়ের পাতা ভূমি স্পর্শ করে থাকে।
আপনার ছোট শিশুর গ্যাসের কারণে পেটব্যথা করলে তার পা ওপরে না তুলে হাঁটু ভাঁজ করে দেবেন। প্রথমে এক পা তুলে ধীরে ধীরে পেটের দিকে ঠেলে হাঁটু ভাঁজ করাবেন। তারপর দ্রুত পা সোজা করে শুইয়ে দেবেন। এরপর অন্য পা একই রকমভাবে করবেন। বারবার এই ব্যায়াম করিয়ে, আপনার শিশুর পেট ম্যাসাজ করে দেবেন।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন
শিশু পেটব্যথার অভিযোগ করলে বেশিরভাগ বাবা-মা এটিকে অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা মনে করে ভয় পান। কিন্তু শিশুর অ্যাপেন্ডিসাইটের ব্যথা হলে সে হেঁটে হেঁটে বলবে না যে, ‘আমার পেটব্যথা করছে।’ তার তখন তীব্র ব্যথা করবে।
শিশু যদি ব্যথার কারণে বিছানা ছেড়ে উঠতে না পারে কিংবা যন্ত্রণায় মোচড় খায়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসককে দেখাতে হবে। শিশুর ব্যথার সঙ্গে যদি জ্বর থাকে এবং বমি বমি ভাব কিংবা বমি হয়, যা খাবার গ্রহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যাবেন। কিংবা শিশুকে দ্রুত হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাবেন।
লেখক : আবাসিক সার্জন, সার্জারি বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।