বি.কে.এস.পিতে বন্ধুরা যখন দেখত ভবিষ্যতের স্বপ্ন, মুশফিকের তখন টেস্ট অভিষেক। অনুর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলা ৩ টেস্ট আর ১৮ একদিনের ম্যাচে যথাক্রমে ৩১ ও ৩৫ গড়ে রান করে দ্যুতি ছড়ানো মুশফিকুর রহীম ডাক পান ২০০৫ এর বাংলাদেশ দলে। বাংলাদেশ দলের প্রথম ইংল্যান্ড যাত্রা। অপরিচিত কন্ডিশনে আর বাউন্সী ট্র্যাকে অনভিজ্ঞতা সব মিলিয়ে শুধু মুশফিকের জন্য না , পুরো বাংলাদেশ দলের জন্যই সফরটি ছিলো একটি চ্যালেঞ্জ। তার উপর খালেদ মাসুদ পাইলটের জায়গায় উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব পাওয়া ১৬ বছর বয়সী মুশি কতটুকু কি করতে পারবেন ইংল্যান্ডে, মানিয়ে নিতে পারবেন কিনা সেটা নিয়ে সংশয় তো ছিলোই।
কিন্তু সকলের মনের সব সংশয় দূর করে দিলেন।
জাতীয় দলের হয়ে প্রস্তুতি ম্যাচে এসেক্স ও নর্দাম্পটনশায়ারের হয়ে খেললেন ৬৩ ও ১১৫ রানের দারুণ দুটি ইনিংস।
সুযোগ পেয়ে গেলেন সেরা একাদশে। ২৬শে মে ২০০৫, লর্ডসের সবুজ ঘাসে অভিষিক্ত হয়ে রেকর্ড গড়লেন ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার মুশফিকুর রহীম। ঘরে বসে তখন প্রার্থনায় রত বাবা মাহবুব হামিদ আর মা রহিমা খাতুন। মা কথা বলতে পারেন না। কথা জড়িয়ে যায়। কিন্তু ছেলের জন্য আবেগ উৎকন্ঠা সবই যে ফুটে উঠেছিলো তার চোখে।
খেললেন মুশফিক, গর্বিত করলেন তার মা বাবাকে। গর্বিত করলেন বগুড়াবাসীকে। ১৯ রান করে অভিষেকটা তেমন স্মরণীয় করতে না পারলেও ১০৮ রানে অলআউট হওয়া বাংলাদেশ দলের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয় ব্যাটসম্যান যিনি কিনা দুই অঙ্কের ঘরে পৌছতে পেরেছিলেন। কিন্তু মুশফিকের কি দূর্ভাগ্য, ইনজুরীতে পড়ে পুরো সিরিজের জন্যই চলে গেলেন মাঠের বাইরে। ঘরে বসে মা রহিমা খাতুনের সে কি কান্না। ইনজুরীতে আক্রান্ত মুশফিকের নিষ্পাপ কচি মুখ কুঁকড়ে যেতে দেখেই বোধহয়। মায়ের মন তো।
২০০৬ অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের অধিনায়কত্ব করলেন। সাকিব-তামিমদের সাথে মিলে দলকে তুললেন কোয়ার্টার ফাইনালে। বিশ্বকাপ শেষেই ডাক পেলেন শ্রীল্ংকা সিরিজের জাতীয় দলে।
ডাক পেলেন ২০০৬ সালের জিম্বাবুয়ে সফরের দলে। ফরহাদ রেজা আর সাকিব আল হাসানের সাথে তিনিও ছিলেন অভিষেকের অপেক্ষায়। হারারেতে জীবনের প্রথম অর্ধশতক হাঁকানো মুশফিকুর রহীম ডাক পেয়ে যান ২০০৭ এর বিশ্বকাপের দলেও। খালেদ মাসুদের বদলে ডাক পান কারণ নির্বাচকদের চোখের তার ব্যাটিংটা বিশেষ নজর কেড়েছিলো।
আবারও ডাক পান ২০০৭ এর জুলাইয়ের শ্রীলংকার বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে। দলে সুযোগ পেয়েই দেখালেন চমক। আশরাফুলের সাথে গড়লেন শষ্ঠ উইকেটে রেকর্ড ১৯১ রানের জুটি।
ব্যাক্তিগত ৮০ রান করে এবং ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের সুবাদে জুটে যায় বোর্ডের সাথে চুক্তিটাও।
কিন্তু বিশ্বকাপের পরে ৫ টি একদিনের ম্যাচে মাত্র ৪ রান করে দল থেকেই বাদ পড়ে যান মুশফিক। তার জায়গায় ডাকা হয় ধীমান ঘোষকে। আবারও ডাক পান ২০০৮ এ ভারত-শ্রীলংকা-বাংলাদেশ ত্রিদেশীয় সিরিজ এবং এশিয়া কাপের দলে। ২০০৯ এ পান সহ অধিনায়কের দায়িত্ব। জিম্বাবুয়ে সিরিজে মাশরাফির অনুপস্থিতিতে অধিনায়কত্ব পাওয়া সাকিব আল হাসানের ডেপুটির দায়িত্ব বেশ ভালোভাবেই পালন করেন মুশি। আমরা সিরিজ জিতি ৪-১ এ। শেষ ম্যাচে মুশি করেন ৯৮ রান। ওই সিরিজে ৫৬ গড়ে করেন ১৬৯ রান।
এর পরের গল্পটা পরিশ্রম আর এগিয়ে যাওয়ার গল্প। কীভাবে কঠোর পরিশ্রম একটা মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ যেন মুশফিকুর রহীম। করলেন ভারতের বিপক্ষে নিজের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরী। ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করে পেলেন জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব। দলকে নিয়ে গেলেন এশিয়া কাপের ফাইনালে, জিতলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ, নিউজিল্যান্ড সিরিজ।
শ্রীলংকার মাটিতে করলেন ২০০ রান। ঘরোয়া লীগ বলেন কিংবা জাতীয় দল দুই জায়গাতেই সমানভাবে পারফর্ম করে যেতে লাগলেন।
তার ধারাবাহিকতার নমুনা বুঝা যায় তার টেস্ট আর ওয়ানডে ব্যাটিং গড়ের ক্রমাগত বৃদ্ধি দেখলে। আর এখন তো তিনি আমাদের ভরসার প্রতীক।
ছোট্ট মুশির ছোট্ট কাঁধে এখন জাতির প্রত্যাশার ভার।
অনেক প্রত্যাশা, অনেক চাপ…সামলাচ্ছেন সিদ্ধহস্তে।
খারাপ একটা বছর যাচ্ছে ঠিকই, সমালোচিতও হয়েছেন ঠিকই কিন্তু ব্যাট হাতে ঠিকই বাংলাদেশীদের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। আছেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
শেষ করব মুশফিককে নিয়ে করা তার কোচ সালাহউদ্দিনের একটি উক্তি দিয়ে-
” বগুড়ার সবচেয়ে নামজাদা আর সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম মুশফিকের। চাইলেই আরাম আয়েশ করে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারত। কিন্তু বেছে নিলো কঠিন জীবনকে। ওর মত পরিশ্রমী এবং ডেডিকেটেড খেলোয়াড় আমি খুব দেখেছি। হয়ত প্রতীভার দিক দিয়ে অন্য অনেকের থেকেই কিছুটা পিছিয়ে ছিলো কিন্তু সবসময় ছিলো সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। আর ব্যাবহারে ছিলো খুবই নম্র এবং ভদ্র। এখানকার(বি কে এস পি) কারো কাছেই মুশফিক সম্পর্কে খারাপ কিছু শুনবেন না কোনোদিন”