ekti rashter jonm o prosrab bedonar citkar

image

একটি রাষ্ট্রের জন্ম ও প্রসব বেদনার চিৎকার!

২৬শে মার্চ, ১৯৭১। পৃথিবীর মানচিত্রে “বাংলাদেশ” নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম। আমার মা তখন দুই মাসের প্রেগনেন্ট। দুই বৎসরের একটা ছেলে, পাঁচ ও আট বৎসরের দুইটা মেয়ে নিয়ে অসম্ভব এক সংগ্রামী জীবন।পাঞ্জাবিরা আসছে এলাকায়, খুঁড়বে বেঙ্কার/থাকার বাসস্থান। চারদিকে এক আতংক। গুলাগুলি শুরু, দেশ এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশের মাঝে। এলাকার মানুষ দলে দলে যাচ্ছে বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাড়ী-ঘরে। যুবকরা যাচ্ছে মুক্তিবাহিনীতে। দেশে চলছে পাক হানাদারদের ধরপাকর আর ধ্বংসনীলা। এভাবে চলতে চলতে আসল জুলাই/আগস্ট মাস। তারই মাঝে বর্ষাকাল। আমার মা তার ৭ মাসের প্রেগ্নেন্সি ও তিন বাচ্চা নিয়ে অসম্ভব নিরাপত্তাহীনতায়। এই অবস্থায় ৭/৮ মাইল দূরে নিবড়া গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়ীতে চলে গেলেন। সাথে তাঁর বাসুর স্কুল শিক্ষক ও জা এবং ৫ জন ছেলে-মেয়ে। চাল-ডাল ও খাবার নিয়ে তাঁর স্বামী গেলেন তিনদিন পর। জন্ম হল তাঁর সন্তান অক্টোবরে। এই যে একটি রাষ্ট্রের জন্মের সাথে আমার মায়ের প্রসব বেদনা, কত কষ্ট! কত নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন! আমার মায়ের মত রাষ্ট্রের প্রসব বেদনায়: ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিল, দুই লক্ষ মা-বোন নির্যাতিত, মাইলের পর মাইল রাস্তা ঘাঠ ধ্বংস করে দিল, শত-শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তছনছ করে দিল। দেশের মেধাবী-বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হল। ফলে পেলাম একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। এই স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম ও আমার মায়ের প্রসব বেদনার চিৎকার নিয়ে আজকের লেখা…

 

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা নিয়ে লিখতে গেলে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।২৩শে মার্চ,১৯৪০ সাল। পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে সর্বভারতীয় মুসলিমলীগের ২৭তম বার্ষিক অধিবেশনে বাংলার নেতা ও প্রধানমন্ত্রী আবুল কাশেম ফজলুল হক, যিনি শেরেবাংলা নামেই বেশি পরিচিত, প্রস্তাব উত্থাপন করেন যে ‘যেসব অঞ্চলে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, যেমন ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চল-সেগুলো একই দলভুক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠন করতে পারে, যেখানে গঠনকারী প্রতিটি ইউনিট হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।’ প্রস্তাবটি পরদিন পাস হয়। এই প্রস্তাবের সূত্র ধরেই সাত বছরের মাথায় ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান এবং হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় ভারত। নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান দুই হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত দুটি প্রদেশের সমন্বয়ে গঠিত হয়-পূর্বপাকিস্তান(অধুনা বাংলাদেশ)ওপশ্চিম পাকিস্তান।ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে যোজন যোজন ব্যবধানে অবস্থিত এ দুটি অংশের মধ্যে মিল ছিল কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মে। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই এর পূর্ব অংশ পশ্চিম অংশের তুলনায় নানাভাবে বঞ্চিত হতে থাকে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ বছর ছিল পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস।

 

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশিদের স্বাধীকার আন্দোলন, এমনকি জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলের আইনসঙ্গত অধিকারকেও রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শুরু করেছিল সারাদেশে গণহত্যা। সেইরাতে হানাদাররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, রোকেয়া হল, শিক্ষকদের বাসা, পিলখানার ইপিআর সদরদপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে একযোগে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে হত্যা করে অগণিত নিরস্ত্র দেশপ্রেমিক ও দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। পাকহানাদার বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একাধিক গণকবর খুঁড়ে সেখানে শত-শত লাশ মাটি চাপা দিয়ে তার ওপর বুলডোজার চালায়। নগরীর বিভিন্ন স্থানে সারারাত ধরে হাজার হাজার লাশ মাটি চাপা দেয়া হয়। পুরানো ঢাকার বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়া হয় নিহতদের লাশ।২৬শে মার্চ ঢাকা সেনানিবাসের ভেতরে আদমজী কলেজ থেকে বন্দি অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে সারাদিন আটক রেখে সন্ধ্যায় অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধ্যায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে ৮৭০ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার থেকে এই বেতারকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করা হয়।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ ও স্বাধীনতার ঘোষণাভিত্তিক তারবার্তার আদলে স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কিত অনুষ্ঠান ২৬শে মার্চ কালুরঘাট থেকে সম্প্রচার করেন এম এ হান্নান, সুলতানুল আলম, বেলাল মোহাম্মদ, আবদুল্লাহ আল-ফারুক, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, কবি আবদুস সালাম এবং মাহমুদ হাসান৷

 

পূর্ববাংলা রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান প্রথমে নিজের নামে ও পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হয়ে ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, যা এই ভূ-খণ্ডের সেনাবাহিনী ও অন্যান্য ফোর্সের মাঝে উৎসাহ বিরাজ করে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রচার করে, ফলে বিশ্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে জানতে পারে।১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা হয় কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমা (বর্তমানে জেলা) বৈদ্যনাথতলার অন্তর্গত ভবেরপাড়া (বর্তমান মুজিবনগর) গ্রামে। শেখ মুজিবুর রহমান এর অনুপস্থিতিতে তাঁকে রাষ্ট্রপতি করে সরকার গঠন করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দিন আহমদের উপর। বাংলাদেশের প্রথম সরকার দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের সামনে শপথ গ্রহণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পালন শুরু করে। এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে ২৬ মার্চ হতে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধগুলো ছিল পরিকল্পনাহীন ও অপ্রস্তুত। ২৬মে মার্চ সারা দেশে প্রতিরোধ শুরু হয় এবং এপ্রিলের শুরুতেই প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। কিন্তু অস্ত্রপ্রাপ্তি ও প্রশিক্ষণ - এই দুইয়ের ঘাটতির কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই পরিকল্পিত রূপ পেতে পেতে জুন মাস পার হয়ে যায়। ১১ই জুলাই বাংলাদেশের সামরিক কমান্ড তৈরি করা হয়। কর্নেল (অবঃ) মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবঃ) আব্দুর রবকে উপসেনাপতি এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন (সক্রিয়) আব্দুল করিম খন্দকারকে দ্বিতীয় উপসেনাপতির ও বিমান বাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। বাংলাদেশকে সর্বমোট ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে প্রতিটি সেক্টরের জন্যে একজন করে অধিনায়ক নির্বাচন করা হয়।দীর্ঘ নয় মাস চলে যুদ্ধ। রাশিয়া ও ভারত সরকার সমর্থন করে বাংলাদেশকে, অন্যদিকে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে পাকিস্তানকে। পাকিস্তান যখন আত্মসমর্পণ করার সুযোগ খুঁজে, ঠিক তখনি অন্য কান্ড ঘটায়।

১৪ই ডিসেম্বর রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনীর সহযোগীতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ জন বুদ্ধিজীবীকে - যাঁদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী - ধরে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তারা ৯৩,০০০ হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। এরই মাধ্যমে নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান ঘটে; প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালি জাতির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র “বাংলাদেশ”। পাকিস্তানি ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি, ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর পূর্ব রণাঙ্গনের প্রধান কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সামনে আত্মসমর্পণের নির্দশনপত্রে স্বাক্ষর করেন।

সবশেষে বলি, দেশটা আমাদের মা। মা, পৃথিবীর অন্যতম সুমধুর একটি শব্দ।এই ডাকটি মুখে আসতেই যেন মনে এক শ্রদ্ধাময়ী, মমতাময়ী চরিত্র সামনে এসে দাঁড়ায়। যার সমস্ত রাগ, অভিমানের আড়ালে লুকিয়ে থাকে নিগূঢ় ভালোবাসার মানচিত্র।মাধুরী মিশানো এই ছোট্ট শব্দটির মধ্যে কত সহস্র আবেগ-অনুভূতি জড়িয়ে আছে, কত শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, স্নেহ জড়িয়ে রয়েছে তা কি কোনো লেখনি দিয়ে প্রকাশ করা যাবে। কখনই না, শত সহস্র বছরেও না। একজন সন্তানের জন্য মা পৃথিবীতে সবচেয়ে আরোধ্য ব্যক্তি, সবচেয়ে পূজনীয় ব্যক্তি, সবচেয়ে কাছের মানুষ।যাকে সব বলা যায় প্রাণ খুলে, নি:সংকোচে।যার কাছ থেকে পাওয়া যায় হূদয় নিংড়ানো ভালবাসা।কত স্নেহ, কত আদর, কত শাসন কত কিছু! মায়ের স্নেহের শীতল আচলে যিনি শৈশব, কৈশোর, যৌবন পার করেছেন তার চেয়ে আর কে বা ভাগ্যবান।এই পৃথিবী কত বিষাদময়, কত শূন্য, কত-না দীর্ঘশ্বাসে ভরা, কত শত বেদনায় জর্জরিত। ঠিক আমাদের দেশ “মা” জন্ম নিতে গিয়েও অসম্ভব নিদারুণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল। যা আমার মায়ের প্রসব বেদনার সমতুল্য। সেলুট তোমায় মা, সেলুট আমার বাংলাদেশ।

লেখক: মোঃ তাজুল ইসলাম (হানিফ) , বিএসএস (অনার্স), এমএসএস (রা.বি), এল.এলবি।

প্রভাষক---- সরকারি আদর্শ মহাবিদ্যালয় (অনার্স কলেজ), সৈয়দাবাদ, কসবা, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া ।