সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বীরপ্রতীক কাকন বিবি মারা গেছেন। বুধবার দিবাগত রাত সোয়া ১১টায় দিকে তিনি মারা যান বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের দুর্ঘর্ষ গুপ্তচর, পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে একাধিকবার বন্দি ও নির্যাতিত মুক্তিযোদ্ধ, বীরাঙ্গনা কাকন বিবি বীরপ্রতীক মৃত্যুর কাছে হার মানলেন। বুধবার রাত সাড়ে ১১ টার দিকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যু বরণ করেন। তিনি নিউমোনিয়া, শরীরের লবণ কমে যাওয়াসহ শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। কাকন বিবির মেয়ে সকিনা মায়ের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
গত সোমবার রাত সাড়ে ৯টায় গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাকে দোয়ারাবাজার থেকে সিলেট নিয়ে আসা হয়। পরে তাকে হাসপাতালের তৃতীয় তলার ১০ নম্বর কেবিনে ভর্তি করা হয়। রাতে অবস্থার অবনতি হলে তার আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়।
সকিনা বলেন, তিনদিন ধরে জ্বরে ভুগছেন মা কাকন বিবি। এরপর থেকে তার কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে দোয়ারাবাজার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হয়। তখনই ইউএনও কাকন বিবিকে দ্রুত ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে আসতে আর্থিক সহযোগিতাসহ সবধরণের সহযোগিতা করেছেন।
সখিনা আরো বলেন, গত বছরের ২১ জুলাই ব্রেনস্টোক করেন। এরপর থেকে শারীরিক অবস্থা ভালো যাচ্ছে না।
জানা গেছে, ভারতের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে খাসিয়া সম্প্রদায়ের এক পরিবারে জন্ম কাকন বিবির। ১৯৭০ সালে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার শহীদ আলীর সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের পর নাম পরিবর্তিত হয়ে নুরজাহান বেগম করা হয়। তার বর্তমান বসতি সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে।
কাকন বিবি মাত্র তিন দিনের শিশু কন্যা সন্তান সকিনাকে রেখে যুদ্ধে চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর বিপক্ষে মুক্তিবাহিনীর হয়ে শুধু গুপ্তচর হিসেবেই কাজ করেননি, করেছেন সম্মুখযুদ্ধও। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বীরপ্রতীক খেতাব দেওয়া হয়।
কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে স্বামীর সঙ্গে কাকন বিবির প্রথম সংসার ভেঙে যায়। পরবর্তীতে ইপিআর সৈনিক মজিদ খানের সঙ্গে কাকন বিবির বিয়ে হয়। মজিদ তখন কর্মসূত্রে সিলেট ইপিআর ক্যাম্পে থাকতেন। দুই মাস সিলেটে স্বামীর সঙ্গে বসবাস করার পর তিনি আগের স্বামীর ঘর থেকে মেয়ে সকিনাকে নিয়ে আসেন। মেয়েকে নিয়ে এসে তিনি স্বামীকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, স্বামী বদলি হয়ে দোয়ারাবাজার সীমান্ত এলাকার কোনো এক ক্যাম্পে আছেন। সীমান্তবর্তী ঝিরাগাঁও গ্রামে শহীদ আলীর আশ্রয়ে মেয়েকে রেখে দোয়ারাবাজারের টেংরাটিলা ক্যাম্পে যান তিনি।
১৯৭১ সালের জুন মাস তখন। পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন। তাদের বাঙ্কারে দিনের পর দিন অমানুষিকভাবে নির্যাতন সহ্য করতে হয় কাকনকে। এরপর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তখনই কাকন স্বামীকে পাওয়ার আশা ত্যাগ করে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন।
জুলাই মাসে তার সঙ্গে দেখা হয় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী তার সঙ্গে সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর শওকতের দেখা করিয়ে দেন। তার ওপর দায়িত্ব পড়ে গুপ্তচর হিসেবে বিভিন্ন তথ্য জোগাড়ের। কাকন বিবি শুরু করেন পাকিস্তানিদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা। তার সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালিয়ে সফল হন।
গুপ্তচরের কাজ করতে গিয়েই দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজারে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ফের ধরা পড়েন তিনি। এবার একনাগাড়ে ৭ দিন পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা তাকে বিবস্ত্র করে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। লোহার রড গরম করে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছেঁকা দেয়। মৃত ভেবে অজ্ঞান কাকন বিবিকে পাকিস্তানি বাহিনী ফেলে রেখে যায়। তাকে উদ্ধার করে বালাট সাব সেক্টরে নিয়ে আসা হয়। সুস্থ হয়ে তিনি আবার ফিরে আসেন বাংলাবাজারে। অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ নেন। মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী তাকে প্রশিক্ষণ দেন। পরবর্তীকালে তিনি সম্মুখ যুদ্ধে আর গুপ্তচর উভয় কাজই শুরু করেন।
কাকন বিবি প্রায় ২০টি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করার ঘোষণা দেন।