উত্তরায় কিশোর গ্যাংগুলো ফের পুরোদমে সক্রিয়। এই গ্যাং এখন রীতিমতো আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের বেপরোয়া কাণ্ডে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। চায়ের দোকান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনের সড়ক এমনকি বিভিন্ন শপিং মলের আশপাশে কিশোর গ্যাংয়ের একাধিক দলের সদস্য ঘোরাঘুরি করে। চায়ের দোকানগুলোয় সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি আড্ডায় মেতে থাকে। আর স্কুল-কলেজের ছুটির সময়ও এদের উৎপাতে অস্থির হয়ে ওঠেন সেখানে আগত অভিভাবকরা।
পাশাপাশি রাস্তাঘাট এমনকি দিয়াবাড়ির মতো নিরিবিলি পরিবেশকে তারা মুহূর্তে অশান্ত করে তোলে। এমনই নানা অভিযোগ স্থানীয়দের।
দিয়াবাড়িতে রেহানা নামের এক চায়ের দোকানি বলেন, এই ছেলেগুলো প্রতিদিন গ্রুপে গ্রুপে আসে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দোকানে বসে থাকে। ছোট্ট বাচ্চা। বয়স মনে হয় ১৫-১৬ বছর হবে। আর এরাই একটার পর একটা সিগারেট টানে। কোনো মুরব্বিও মানে না। যতক্ষণ থাকে তাদের দখলে চলে যায় দোকানটা। তিন-চারজন হলে একটা কথা। একসঙ্গে আট-দশজন আসে। রেহানার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিশোরদের এই গ্রুপগুলো দিয়াবাড়ির বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেয়। একেক জায়গায় একেক গ্রুপ বসে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটি মোটরসাইকেলে তিনজন করে আসে। চায়ের দোকানে ভিড় করে হইহুল্লোড় করেই ক্ষান্ত হয় না কিশোর গ্যাংয়ের ওই দলগুলো। দিয়াবাড়িতে বেড়াতে আসা সাধারণ মানুষদেরও উত্ত্যক্ত করে তারা। বিশেষ করে কোনো প্রেমিক যুগলকে একসঙ্গে বসে গল্প করতে দেখলে নানাভাবে বিরক্ত করে। এতে কেউ ক্ষিপ্ত হলে তার ওপর চড়াও হয়।
সরজমিন গতকাল দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, একদল কিশোর যাদের বয়স ১৬-১৭ বছর। কারো পরনে কলেজের ইউনিফর্ম। আবার কেউ সাধারণ পোশাকে। দিয়াবাড়ির বটতলা থেকে একটু এগিয়ে দেখা মেলে তাদের। ৪টি মোটরসাইকেলে করে আটজন এসেছে। স্কুল-কলেজের পোশাক পরিহিত হলেও তাদের কারো কাঁধে ব্যাগ ছিল না। এদের মধ্যে একজন অনিক নাম ধরে আরেকজনকে ডাক দিতে শোনা যায়। একে অপরকে বলছিল ‘নেক্সট মিশন’ কি হবে। কিন্তু কি মিশন নিয়ে কথা বলছিল সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। পার্শ্ববর্তী এক চটপটি ব্যবসায়ীর কাছে গিয়ে জানা গেল এদের সবার ফেসবুকে একটা গ্রুপ আছে। কেউ নাইনএমএম বয়েজ উত্তরা আর কেউ ডিস্কো বয়েজ নামে পরিচিত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই চটপটি ব্যবসায়ী জানান, প্রায়ই তার দোকানে এসে অড্ডা দেয় কয়েকটি গ্রুপ। তবে একাধিক গ্রুপ একসঙ্গে আসে না। তাদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের কারণে কেউ কারো সামনে আসে না। তিনি বলেন, এদের মধ্যে মারামারির ঘটনা হয়। মাঝে মাঝে এই রাস্তার উপরই মারামারি শুরু করে। মারামারির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ওই চটপটি ব্যবসায়ী বলেন, কি নিয়ে মারামারি হয় সেটা তাদের আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। তবে একই এলাকায় ‘সিনিয়র-জুনিয়র’ হওয়া নিয়ে মারামারি বাঁধে। কয়েকবারই দোকানের সামনে এসে মারামারি করেছে। মাঝে মাঝে তাদের এসব কাণ্ড দেখে ভয়ে অনেকে এখানে বসতে চান না। এদিকে কিশোর গ্যাংগুলোর আতঙ্কে উত্তরার স্থানীয়রাও। ১২নং সেক্টরের (সোনারগাঁও জনপথ) পরের রাস্তাটি অনেকটাই ফাঁকা থাকে প্রায় সময়। এই জায়গাগুলোতে সন্ধ্যার পর আড্ডা জমায় ১০-১২ জনের মতো কিশোর। মাঝে মাঝে তারা এলাকার মধ্যে হট্টগোল বাধিয়ে দেয়।
আশপাশের চলাচলকারী অনেকেই তাদের ঝামেলার কারণে পথ চলতে অসুবিধায় পড়েন। বেশির ভাগ সময় এদের একগ্রুপ আরেক গ্রুপের মধ্যে মারামারি করে। একপর্যায়ে কেউ কেউ মারাত্মকভাবে জখম হতেও দেখা যায়। আর এ সময় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এলাকাবাসী। অত্র এলাকায় বসবাসকারী সাইদুল হক নামের এক ব্যক্তি জানান, এই ছোট ছোট ছেলেগুলো সন্ধ্যার পর আড্ডা জমায়। পড়ালেখার কোনো খবর নেই। দিনের বেলায় স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা আর রাতে আড্ডা দেয়া তাদের কাজ। মাঝে মাঝে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। তখনই ভয় হয়। শুনেছি এরা এখন আরো আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে।
গত ২০শে মার্চ ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে নাবিল নামের এক স্কুলছাত্রকে ছুরিকাঘাত করে জীবন ঢালী নামের আরেক কিশোর। জানা যায়, জীবন ঢালী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। এ বিষয়ে উত্তরার পশ্চিম থানায় মামলা হওয়ার পর জীবনের পরিবার তাকে থানায় নিয়ে পুলিশের হেফাজতে দেয়। তবে গতকাল সে কিশোর আদালত থেকে জামিন পায় বলে জানান উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী হোসেন। তিনি বলেন, জীবনকে তার পরিবার থানায় নিয়ে এসেছিল। তারপর আমরা আইনি ব্যবস্থা নিয়ে আদালতে পাঠালে আদালত তাকে জামিন দেন। আসলে ছেলেটি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল। যে কারণে নাবিলের ওপর ওভাবে ছুরিকাঘাত করে।
উত্তরা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের এই উৎপাত প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আলী হোসেন আরো জানান, এই বয়সটাতে ছেলেরা এসবই করে বেড়ায়। এটা যুগ যুগ ধরে দেখে আসছি। তবে এখানে অভিভাবকরা যদি তাদের সন্তানদের সঠিকভাবে যত্ন না করেন তাহলে আরো আক্রমাণত্মক হয়ে উঠবে ওরা। সন্তানদের প্রচুর ভালোবাসতে হবে। তাদের খোঁজ খবর নিতে হবে। আমিও একজন বাবা। আমার দুটি ছেলে রয়েছে। তাদের প্রতিদিন বাসায় গিয়ে চুমু খাই। তারা অপেক্ষা করে বাবা কখন আসবে আর কখন চুমু খাবে। এই বন্ধনটা প্রত্যেক বাবা-মায়ের সন্তানের সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে। আসলে এটাই বড় অভাব। যে কারণে এ ঘটনাগুলো ঘটছে। তবে আমরা যারা আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে রয়েছি সবাই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। প্রতিটি স্কুল-কলেজ ক্যাম্পাস ও শপিং মলগুলোর সামনে পুলিশের টহল থাকছে।