বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া প্যারল (শর্ত সাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি) নিয়ে বিদেশে যেতে চাইলে অনুমতি মিলতে পারে। তবে তাঁর মুক্তভাবে দেশে অবস্থান নিরাপদ মনে করছে না সরকার। এ জন্য বিদেশে যেতে না চাইলে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি আরো দীর্ঘায়িত হতে পারে। আওয়ামী লীগ ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বেগম খালেদা জিয়া বর্তমানে পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। গত ২৮ মার্চ অন্য একটি মামলায় তাঁকে আদালতে হাজির করার কথা ছিল। কিন্তু খালেদা জিয়া যেতে রাজি না হওয়ায় তাঁকে আদালতে পাঠানো যায়নি। ফলে কারাগার থেকে আদালতকে জানানো হয়েছে যে তিনি অসুস্থ থাকায় পাঠানো যায়নি। আদালতে এ তথ্য যাওয়ার পর থেকেই খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে আলোচনা চলছে। সেদিনই সিভিল সার্জন গিয়ে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের খোঁজ নেন। এর পর থেকে খালেদা জিয়া অসুস্থ বলে দাবি করছে বিএনপি। ব্যক্তিগত চিকিৎসক দিয়ে তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার দাবি জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত শুক্রবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, চিকিৎসক বোর্ড বললে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে বিদেশে পাঠানো হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খালেদা জিয়া একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। আমরা তাঁর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে খোঁজখবর রাখছি। আজও (রবিবার) সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে চিকিৎসকরা তাঁকে দেখে এসেছেন। তাঁর পায়ে সমস্যা রয়েছে।’ গুরুতর অসুস্থ হলে তাঁকে প্যারল দেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘যদি সে রকম অবস্থা তৈরি হয়, তাহলে আদালত ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। অবশ্যই সরকার তাঁর (খালেদা জিয়া) সুচিকিৎসার উদ্যোগ নেবে।বিদেশে চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার প্যারলের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, দেশে প্রচলিত আইন আছে। সেই আইন ও কারাবিধি অনুযায়ী খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের সাধারণ সম্পাদক স্পষ্ট বলেছেন, চিকিৎসকরা পরামর্শ দিলে বিএনপি চেয়ারপারসনকে প্রয়োজনে বিদেশে পাঠানো হবে।’ খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য এরই মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চার চিকিৎসকের সমন্বয়ে একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বোর্ডের সদস্যরা গতকাল দুপুরে কারাগারে গিয়ে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছেন। তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত মেডিক্যাল বোর্ড কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নিএদিকে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হবে কি না, তা নিয়ে বিএনপিতে দুই ধরনের মত রয়েছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত শুক্রবার সকালে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের সুপারিশ অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য সর্বোত্তম ব্যবস্থা হচ্ছে, যেটা তাঁর প্রাপ্য তাঁকে জামিনে মুক্তি দিয়ে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যদিকে ওই দিন দুপুরেই বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী এক বিবৃতিতে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, কারামুক্তির পর দেশনেত্রী দেশে, না বিদেশে চিকিৎসা করাবেন সে বিষয়ে তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নেবেন।
সরকার শর্ত সাপেক্ষে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিলে বিএনপি তা কিভাবে দেখবে জানতে চাওয়া হলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না, তাই কোনো মন্তব্য করবেন না।দলীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও আওয়ামী লীগের কোনো নেতাই মনে মনে খালেদা জিয়ার মুক্তি চান না। তাঁদের ধারণা, নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার মুক্তি মিললে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তাঁরা। তাই তাঁর জামিনে মুক্তি ঠেকাতে সব ধরনের কৌশল প্রয়োগ করার পক্ষে তাঁরা। অবশ্য আলোচনা সাপেক্ষে প্যারলে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চাইলে সরকার তার অনুমতি দেবে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসা-পরবর্তী গন্তব্য হতে পারে ব্রিটেন এবং আলোচনায় থাকবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান সপরিবারে লন্ডনে আছেন।
আওয়ামী লীগ সূত্র মতে, বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতি পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মনোবল আরো চাঙ্গা হয়েছে। তিনি সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসভায় জনগণকে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের ইচ্ছা, কমপক্ষে আরো এক দফা ক্ষমতায় থেকে উন্নয়ন কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া। সে ক্ষেত্রে বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলেও তাদের কিছু যায় আসে না।এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে এরই মধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে, খালেদা জিয়াকে ছাড়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না।
খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য গঠন করা চার সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডে আছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সামসুজ্জামান, নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মনসুর হাবীব, মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. টিটু মিয়া এবং ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. সোহেলী রহমান।কারা সূত্রে জানা যায়, মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যরা গতকাল দুপুর সোয়া ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। তাঁরা তাঁর রক্তচাপসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।মেডিক্যাল বোর্ডের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বোর্ডের সদস্যরা চেকআপ করে খালেদা জিয়াকে স্বাভাবিক অবস্থায় দেখতে পেয়েছেন। ওই সময় খালেদা জিয়া তাঁর কী কী অসুবিধা হচ্ছে, সেসব বিষয় জানান মেডিক্যাল বোর্ডকে। মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যরা তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। পরে তাঁরা প্রেসক্রিপশন লিখে কারা কর্তৃপক্ষকে দিয়ে আসেন।মেডিক্যাল বোর্ডের অনিচ্ছুক একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছি। তিনি জানিয়েছেন, ব্যথার যে ওষুধ খাচ্ছেন সেটি মনে হয় কাজ করছে না। এরপর তাঁর ওষুধ বদলে দেওয়া হয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে ওই চিকিৎসক বলেন, ‘দেশের বাইরে পাঠানোর বিষয়ে খালেদা জিয়া কিছু বলেননি। আমরাও কিছু বলিনি।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তাঁর যে অবস্থা তাতে তাঁকে বিদেশে পাঠিয়ে চিকিৎসা করানোর প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করি না।’
রাতে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক মো. ইকবাল হাসান বলেন, ‘মেডিক্যাল বোর্ড উনাকে (খালেদা জিয়া) চেকআপ করেছে। পরে তারা কী কী ওষুধ লাগবে, সে প্রেসক্রিপশন দিয়ে গেছে।’