গত রোববার ঢাকা থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের দুবাইগামী বোয়িং ময়ূরপঙ্খী ছিনতাইচেষ্টার ঘটনায় নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষের মনে। উড্ডয়নের পরপরই যে যুবক ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেছিলেন, তিনি পেশাদার বা সংঘবদ্ধ কোনো জঙ্গি গ্রুপের সদস্য ছিলেন বলে মনে হয় না। প্রথমে বলা হয়েছিল পলাশ আহমদ নামের ওই যুবকের হাতে পিস্তল ছিল। পরে উদ্ধার অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, ওই যুবকের হাতে থাকা পিস্তলটি আসল নয়।
তিন স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী ও দুই দফা তল্লাশি পেরিয়ে অস্ত্রধারী ওই যুবকের ফ্লাইটের ওঠা, পিস্তলটি আসল না নকল, শুধুই কী প্রধানমন্ত্রী ও স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাওয়া- নাকি অন্য কোনো দাবি ছিল ছিনতাইকারীর? এমন অসংখ্য প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি এখনো। আসলে সেদিন কী ঘটেছিল ময়ূরপঙ্খীতে- তা জানতে আরো সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পিস্তলটি আসল হোক আর খেলনাই হোক, সেটি নিয়ে ফ্লাইটের অভ্যন্তরে উঠতে পারার মধ্যে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার বড় ধরনের ত্রুটি দেখছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, যদি সেটি খেলনা পিস্তলও হয়, তবুও তা হ্যান্ডব্যাগে বহন করা সম্ভব নয়। এ ঘটনায় গতকাল সোমবার রাতে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থানায় একটি মামলা দায়ের হলেও জব্দকৃত আলামতগুলো পুলিশের হেফাজতে আসেনি। ফলে পিস্তলটি আসল না নকল তা-ও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
জিম্মি নাটকের অবসানের পর ওই রাতে সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের জিওসি মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমান বলেছিলেন, ওই যুবকের কাছ থেকে একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। আবার কিছুক্ষণ পরেই চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ মাহবুবার রহমান জানান, তার কাছে যে অস্ত্রটি পাওয়া গেছে এটা ফেইক, খেলনা পিস্তল। একই রাতে বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃকক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল এম নাঈম হাসান সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের মেশিনে সিসিটিভি আছে, সবগুলো চেক করব। মেশিনের ভেতর দিয়ে নেইল কাটার, খেলনা পিস্তল, ছুরি-সবই ধরা পড়তে পারে। তাই কীভাবে অস্ত্রধারী বিমানে প্রবেশ করল তা তদন্ত শেষে জানা যাবে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার জাহেদুল ইসলাম বলেছেন, পিস্তলটি খেলনা ছিল, নাকি সত্যিকারের ছিল তা আমরা জানি না। সংগৃহীত আলামত র্যাবের কাছে রয়েছে।
পতেঙ্গা থানার ওসি উৎপল বড়ুয়া জানান, বিমান ছিনতাইচেষ্টার ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যায় সিভিল এভিয়েশনের প্রযুক্তি সহকারী দেবব্রত সরকার বাদি হয়ে পলাশ আহমেদ ও অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছেন। তবে এসময় কোনো আলামত জমা দেয়া হয়নি। তিনি আরো বলেন, শুনেছি পিস্তলসহ জব্দকৃত আলামতগুলো র্যাবের কাছে আছে। আমরা সেগুলো সংগ্রহ করার প্রক্রিয়ায় আছি।
উড়োজাহাজটির কয়েকজন যাত্রী ও ক্রু রবিবার রাতে জানিয়েছিলেন, ছিনতাইচেষ্টাকারীর হাতে পিস্তল ও বোমার মতো কিছু ছিল। ছিনতাইকারী বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটান এবং গুলিও করেন। ফলে খেলনা পিস্তল দিয়ে কীভাবে গুলি করা হলো এ নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, অনেক সময় ছিনতাইকারী খেলনার পিস্তল জাতীয় অস্ত্র নিয়ে ভয় দেখায়। চট্টগ্রামে যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে ওই ব্যক্তির অস্ত্র আছে কি না, এখনো পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে না। অস্ত্রটি পরীক্ষা করা প্রয়োজন। যদি অস্ত্র নিয়ে বিমানের ভেতরে ঢুকে থাকে তাহলে নিরাপত্তার মারাত্মক ঘাটতি। খেলনা পিস্তলও হাত ব্যাগে বহন করার নিয়ম নেই বলে জানান তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমান বাহিনীর এক সাবেক কর্মকর্তা জানান, র্যাবের তালিকায় ওই ব্যক্তি অপরাধী থাকায় সন্দেহ আরো ঘনীভ‚ত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই অনেকে মনে করছেন, অপরাধীর কাছে আসল পিস্তলই থাকবে। ফেসবুকে পিস্তল হাতে ওই যুবকের ছবিও দেখা গেছে। কিন্তু বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে যেন ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন না হয়, এ জন্য হয়ত কেউ কেউ এটাকে খেলনা পিস্তল বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন।
এ বিষয়ে বিমান প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী গতকাল বেবিচকের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমরা পুরো বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেছি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পাওয়ার পর বিষয়টি স্পষ্ট হবে। তিনি বলেন, ঘটনার পর শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে কোনো ত্রুটি পাওয়া যায়নি। সেখানে এমন কোনো লিকেজ ছিল না যাতে একজন যাত্রী এভাবে বিমানে যেতে পারে।
তাহলে অস্ত্রটা ভেতরে গেল কীভাবে- এই প্রশ্নে বিমান সচিব মহীবুল হক বলেন, সেটা অস্ত্র কিনা আমরা ওয়াকিবহাল নই। তদন্ত প্রতিবেদনের পর এটা নিয়ে বিস্তারিত বলতে পারব। তিনি বলেন, আমরা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখেছি। অন্য দশটা যাত্রীর মতো তাকেও তল্লাশি করা হয়েছিল। তার কাঁধে একটা ব্যাগ ছিল। সেটা স্ক্যানারের ভেতর দিয়ে গেছে, কিন্তু সেখানে কিছু দেখা যায়নি।
তবে যাত্রীরা শব্দ পেল কীভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে বেবিচকের চেয়ারম্যান নাঈম হাসান বলেন, এয়ারক্রাফটে গুলি বিনিময় হলে তার চিহ্ন থাকত। আমরা কোনো চিহ্ন কোথাও পাইনি। খেলনা পিস্তলেও শব্দ হয়। যাত্রীরা শব্দ শোনার কথা বলেছে।
এদিকে কোন দাবিতে পলাশ বিমানটি ছিনতাই করতে চেয়েছিল, সে কারণও স্পষ্ট নয়। পুলিশের বিশেষ শাখার ডিআইজি আকমল হোসেন রবিবার রাতে বলেন, ওই যাত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়ার দাবি জানান। আবার তার স্ত্রী নায়িকা শিমলার সঙ্গেও কথা বলতে চেয়েছিলেন পলাশ, এমন খবরও জানা গেছে বিভিন্ন মাধ্যমে। কিন্তু শুধু কি কথা বলা না অন্যকোনো উদ্দেশ্য ছিল এই ছিনতাইচেষ্টার নেপথ্যে- তা নিশ্চিত করতে পারেননি কেউ। অনেকে সন্দেহ করছেন, বিমানটি নাশকতার জন্য অন্যকোনো দেশে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল অস্ত্রধারীর। কেননা, অভ্যন্তরীণ রুটে চট্টগ্রামের যাত্রী হয়ে ওই যুবক বিমানটিতে চড়লেও গত শুক্রবার তিনি দুবাই যাওয়ার কথা বলে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের বাড়ি থেকে বের হন। পলাশের বাবা পিয়ার জাহান সরদার গতকাল গণমাধ্যমকে এ কথা নিশ্চিত করেন।
পলাশের অতীত থেকে জানা যায়, স্থানীয় তাহেরপুর সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ২০১১ সালে দাখিল পাস করেন তিনি। বেয়াড়া স্বভাবের থাকায় তার সঙ্গে পরিবারের সম্পর্ক ভালো ছিল না। কিছুদিন আগে নায়িকা সিমলাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি আসেন। সব শেষ একটানা ১৫ দিন গ্রামের বাড়িতে থাকেন। তখন তিনি নিয়মিত নামাজ পড়েন, এমনকি মসজিদে গিয়ে আজানও দেন। পলাশের এই হঠাৎ বদলে যাওয়া সাধারণত জঙ্গি সম্পৃক্ততার আচরণের সঙ্গে মিলে যায় বলে জানিয়েছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তাই বিমানটি জঙ্গি কাজে ছিনতাইয়ের চেষ্টা হতে পারে বলেও সন্দেহ তাদের।