পাবনার চাটমোহরের আটলঙ্কা গ্রামের রফিকুল ইসলাম ও তাসলিমা খাতুন দম্পতির ঘরে জোড়া মাথা নিয়ে জন্ম নেয় রাবেয়া-রোকাইয়া।দীর্ঘ ও সফল চিকিৎসায় জোড়া মাথা আলাদা হওয়ার পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলদুই বোন রাবেয়া-রোকাইয়া। গতকাল রবিবার দুপুরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) ছেড়ে তাদের গৃহপ্রত্যাবর্তনের অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী রাবেয়া-রোকাইয়ার সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করে বক্তব্যে বলেন, ‘আজ রাবেয়া-রোকাইয়া বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, তাদের মা-বাবার কোলে ফিরে যাচ্ছে। দীর্ঘ ও জটিল চিকিৎসা শেষে রাবেয়া-রোকাইয়া বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, এটা সত্যিই খুব আনন্দের, অন্য রকম অনুভূতি। মুজিব শতবর্ষে রাবেয়া-রোকাইয়ার শুভ গৃহপ্রত্যাবর্তন সবার জন্য অত্যন্ত আনন্দ ও গর্বের। আমি তাদের পরিপূর্ণ সুস্থতা কামনা করছি।’
এ সময় তিনি ভিডিও কনফারেন্সে উচ্ছ্বসিত শিশু রাবেয়া-রোকাইয়ার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। তারা কেমন আছে জানতে চেয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কেমন আছো?’ তখন তাদের একজন বলে, ‘হ্যাঁ, ভালো, তুমি কেমন আছো?’ জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভালো। বাড়ি ফিরতে পেরে খুশি?’ এ সময় মাথা নেড়ে খুশির কথা জানায় দুই শিশুই।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায়ই দেশে-বিদেশে চিকিৎসা পায় দুই শিশু। শুরুতে দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসা নেয় রাবেয়া-রোকাইয়া। সেখানে দুই স্তরে তাদের মস্তিষ্কের রক্তনালিতে অপারেশন করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তাদের হাঙ্গেরি পাঠানো হয়। হাঙ্গেরিতেও ৪৮টি অস্ত্রোপচার করা হয়। যমজ শিশু রাবেয়া-রোকাইয়ার পুরো চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া চিকিৎসায় সার্বিক সহযোগিতা দেয় হাঙ্গেরির দাতব্য সংস্থা অ্যাকশন ফর ডিফেন্সলেস পিপল ফাউন্ডেশন। প্রতি পাঁচ থেকে ছয় মিলিয়ন শিশুর মধ্যে একজনের এ ধরনের বিরল রোগ হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় এটিকে ‘ক্রেনিয়প্যাগাস’ বলে।
২০১৯ সালের ১ থেকে ৩ আগস্ট ঢাকা সিএমএইচে রাবেয়া-রোকাইয়ার জোড়া মাথা আলাদা করার জটিল অস্ত্রোপচার শুরু হয় এবং ৩৩ ঘণ্টা পর তাদের মাথার খুলি ও ব্রেন আলাদা করা সম্ভব হয়; যা বাংলাদেশে চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক অনন্য সাফল্য বলে মনে করা হয়। এ ধরনের অস্ত্রোপচার সারা বিশ্বেই বিরল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রথম। অস্ত্রোপচার-পরবর্তী সাফল্যও বিশ্বে খুব বেশি নেই। জটিল এই অপারেশনের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন ফ্রিডম’। এই অপারেশনে ৩৪ জনের হাঙ্গেরিয়ান সার্জিক্যাল টিম এবং হাঙ্গেরি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে সিএমএইচের নিউরো অ্যানেসথেসিওলজিস্ট, নিউরো ও প্লাস্টিক সার্জনসহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট, হার্ট ফাউন্ডেশন, নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও শিশু হাসপাতালের শতাধিক সার্জন ও অ্যানেসথেসিওলজিস্ট অংশ নেন। মূল অপারেশনের পর বিভিন্ন ধাপে রাবেয়া-রোকেইয়ার আরো বেশ কয়েকটি অপারেশন সম্পন্ন হয়। সর্বশেষ গত বছরের ২৮ অক্টোবর তাদের চতুর্থ ধাপের অপারেশন হয়। জন্মগত অন্য কিছু ত্রুটি ছাড়া তারা বর্তমানে প্রায় সুস্থ আছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি আজকে সত্যিই খুব আনন্দিত এত দীর্ঘ চিকিৎসার পর রাবেয়া-রোকাইয়ার সফল অস্ত্রোপচার হয়েছে এবং এই মার্চ মাস বাঙালির ইতিহাসের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ মাস। এই মাসেই আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেছেন। এই মাসেই আমরা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আবার এই মাস থেকেই কিন্তু আমাদের ভাষা আন্দোলনের যাত্রা শুরু। সেই মার্চ মাসেই আজকে আমাদের প্রিয় রাবেয়া-রোকাইয়া নিজের ঘরে ফিরে যাচ্ছে এবং মা-বাবার কোলে আজকে দুই বোন। এটা সত্যিই খুব আনন্দের। সত্যিই অন্য রকম অনুভূতি।’