সীতাকুণ্ডে ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে ভিডিও করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন আরও অন্তত সাতজন। কনটেইনারে দাউ দাউ করে জ্বলছিল আগুন। উৎসুক কর্মচারী-শ্রমিকেরা দেখছিলেন দাঁড়িয়ে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ব্যস্ত আগুন নেভানোর কাজে। এসব দৃশ্য ফেসবুকে প্রচার করছিলেন তরুণ অলিউর রহমান। ৪৫ মিনিটের লাইভ তাঁর। ৪১ মিনিটের মাথায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ। এরপর সবকিছু অন্ধকার। তবে শোনা যায় আর্তনাদ।
অলিউরের করা বিস্ফোরণের ওই ভিডিও গত শনিবার রাতে ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, আরও কয়েকজন মুঠোফোন নিয়ে আগুনের ভিডিও করছেন। তবে ঘটনাটি মানুষের চোখের সামনে প্রথম তুলে ধরা সেই অলিউরই প্রাণ হারান। তিনি ছিলেন সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর শ্রমিক। বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের ফটিগুলি গ্রামে।
সীতাকুণ্ডে ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে শুধু অলিউর নন, ভিডিও করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন আরও অন্তত সাতজন। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন এখনো নিখোঁজ। এঁদের মধ্যে আছেন মো. ইয়াসিনও (২৬)। তিনি ছিলেন ডিপোর কাভার্ডভ্যানের চালক। তাঁর বাড়ি ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার গোসাইপুর গ্রামে। ফেসবুকে ইয়াসিনের লাইভটি ছিল তিন মিনিটের। এর মধ্যেই বিস্ফোরণ হয়। ইয়াসিনেরও খোঁজ মেলেনি।
অন্যদিকে ডিপোর ক্রেনচালক মো. আকতারের লাইভটি চলেছিল ২০ মিনিট। ১১ মিনিটের মাথায় বিস্ফোরণ হয়। এরপর আরও ৯ মিনিট চালু ছিল মুঠোফোনটি। আকতারের খোঁজে গতকাল মঙ্গলবারও ছবি নিয়ে হাসপাতালে ঘুরেছেন বাবা নুরুল আমিন। আকতারের বাড়ি বাঁশখালীর নাপোড়ায়। আকতারের বোন মুন্নি আক্তার বলেন, ‘ভিডিও দেখে তাঁকে ফোন করে সরে যেতে বলি। কিছুক্ষণ পরই বিস্ফোরণ হয়।’
বাঁশখালীর পুঁইছড়ি ইউনিয়নের নাপোড়া গ্রামের আরেক বাসিন্দা তোফায়েল ইসলাম। বয়স হয়েছিল তাঁর মাত্র ২২। ডিপোতে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অগ্নিকাণ্ডের পর তিনিও লাইভ করেছিলেন। তাঁর লাইভ চলে পাঁচ মিনিট। তিনিও নিখোঁজ।
নোয়াখালীর সুবর্ণচরের বাসিন্দা মো. শাকিব (১৯)। ডিপোর কাভার্ড ভ্যানের হেলপার হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। তাঁর লাইভটি চলেছিল প্রায় তিন মিনিটের মতো। এ ছাড়া আবদুস সোবহান নামে ডিপোর আইসিটি দপ্তরের তত্ত্বাবধায়কও অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণ করছিলেন। তিনিও নিখোঁজ আছেন। তাঁর সাত মাস বয়সী মেয়ে ফাইযা রহমান গত সোমবার ডিএনএ নমুনা দেয়।
২৭ বছর বয়সী ইব্রাহীম হোসেন অপর একটি কোম্পানির অধীনে ডিপো এলাকায় শিপিং সহকারী পদে চাকরি করতেন। ডিপোতে আগুন লাগার পর তিনি ফেসবুকে লাইভ করছিলেন। পরে বিস্ফোরণে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর লাশ যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার জহুরপুর ইউনিয়নের নরসিংহপুর গ্রামে দাফন করা হয়।
ডিপোর শিফট ইনচার্জ শাহাদাত উল্যা মজুমদার (২৯) নির্ধারিত সময়ে দায়িত্ব পালন শেষে ডিপোর পাশের বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আগুন লাগার কথা শুনে ডিপোতে গিয়ে প্রথমে স্ত্রীকে ভিডিও কলে আগুন দেখান তিনি। এরপর আগুনের দৃশ্য বাবাকে দেখানোর সময়ই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর। পরে তাঁর লাশ ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর গ্রামে দাফন করা হয়।
এ রকম ঘটনায় মানুষের সচেতনতা দরকার বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এস এম মনিরুল হাসান। তিনি বলেন, প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে ভিডিও করার এ প্রবণতা তৈরি হয়েছে। অগ্নিকাণ্ড বা বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে এ ধরনের ভিডিও ধারণ করতে হলে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে।তা মানুষের জানা নেই।